Home » বাংলাদেশে বইমেলায় নিরবে প্রকাশিত হয়ে গেলো বাংলিশ ভাষায় বই! দায় কার?

বাংলাদেশে বইমেলায় নিরবে প্রকাশিত হয়ে গেলো বাংলিশ ভাষায় বই! দায় কার?

৫২, ৭১ এ রক্ত আর ইজ্জতের বিনিময়ের পাওয়া স্বাধীন এই বাংলাদেশে এক শ্রেণি সবসময় বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞা করে আসছে। ইংরেজি অক্ষরে বাংলা প্রকাশ! অদ্ভুত এক ফেসবুকীয় ভাষার প্রচলণ দেখা দেয় ২০১৪ এর দিকে। বাংলাতে টাইপিং করার সুযোগ থাকার পরেও বর্তমান জেনারেশন বাংলিশকে প্রধান ভাষা হিসেবে বেছে নিয়েছে! আজ শুধু যে ফেসবুক আর ম্যাসেঞ্জারে সীমাবদ্ধ তা নয়। অনলাইন প্লাটফর্মে হাজার কয়েক ফলোয়ার আর লাইক-কমেন্ট পাওয়াখ্যাত ‘রাবা খান’ নামক অনলাইন সেলিব্রিটি এবারের বইমেলা ২০১৯ এ প্রকাশ করেছেন ‘বান্ধobi’ নামে অদ্ভুত ভাষার একটি বই। বইমেলা জুড়ে দেদারছে বিক্রি হয়েছে এই বাংলিশ বইটি। ‘রকমারি’ নামক অনলাইন বইবিক্রির বাজারে ‘বেস্ট সেলার’ খেতাব পেয়েছে এটা!

বইমেলাতে বাংলাভাষীর মেলা বসে। সেখানে প্রকাশিত হয় নবীন প্রবীণ লেখক-কবির নতুন-পুরাতন বই। বাংলা ভাষাকে ছড়িয়ে দিতে বাংলা একাডেমি এমন আয়োজন করে থাকে। বাঙালির প্রাণের মেলা অমর একুশে বইমেলাতে এমন জগাখিচুড়ি ভাষায় বই প্রকাশিত হয়ে বিক্রির প্রথম সারিতে চলে এলো অথচ আমরা জানতেও পারলাম না!

বাংলা বর্ণকে অবজ্ঞা করে ইংরেজি হরফে বাংলা লেখার সাহস এতটাই আমাদের যে, বইমেলায় একটা বই প্রকাশ পেলো অথচ কোনো উচ্চবাচ্য হলো না?

তারমানে বাংলাদেশে ‘বাংলা’ নামক ভাষা কি শুধু মুখেই সীমাবদ্ধ হয়ে গেলো? একজন বাংলাপ্রেমী লেখক-কবিও কি এই ‘অভাগা বাংলা’ পেলোনা? যে এই বই কীভাবে প্রকাশিত হয়েছে? সেই প্রশ্ন করার! একটা প্রতিবাদও হলোনা তখন? তবে কি বাংলাকে ভুলতে বসেছি আমরা? বাংলিশেই বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা পেতে যাচ্ছে? তাহলে বলবো, ‘’মুক্তিযুদ্ধ আর ভাষা আন্দোলনকেও শ্রদ্ধা করতে শিখিনি আমরা আজও।‘’

আমি অবশ্যই দায়ী করবো প্রকাশনীকে। এমন অনেক লেখক-কবি আমি দেখেছি, যাদের পাণ্ডুলিপি কত-শত প্রকাশনীর প্রকাশের অনীহায় চোখের জলে ধুয়ে গেছে। বাংলার প্রাণের মেলা কীভাবে একটা বাংলিশ বই প্রকাশ করলো?- আমার বোধগম্য হলোনা।

উঠতি যুবতির কাঁচা হাত- মস্তিস্কে অহেতুক নামে-বেনামে লেখা কয়েকটা অযাচিত গল্প নামক অখাদ্যকে বই আকারে প্রকাশ করে দেশে বিদ্যমান অন্যসব প্রকাশনীকেও হেয় করার দায় এড়াতে পারেনা এই বই প্রকাশক।

বাংলা একাডেমি শুরু থেকেই বাংলাপ্রেমীদের রোষের স্বীকার হয়ে আসছে। ‘’বাংলাকে রক্ষার একটা প্রতিষ্ঠানের নাম কেন বাংলা-ইংরেজিতে মিশ্রিত?’’ সেটাও অনেকের প্রশ্ন। বাংলিশ ভাষায় এই বইটি প্রকাশিত হবার দায় অনেকে বাংলা একাডেমির উপরও ফেলছেন। ‘’কেন তারা নজরদারির বিধান রাখেনি? আর নজরদারি থাকলেও কীভাবে এই বান্ধobi বিক্রি হচ্ছে?’’ – তারা প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছেন।

গ্রামের রাবেয়া খাতুন একন রাবা খান হয়ে গেছেন এখন। বাংলায় জন্মানো এই সেলেব্রিটি হয়তো লেখিকা হিসেবে নিজেকে জাহির করতে চেয়েছেন। চেয়েছেন আধুনিক শ্রেণিতে বিচরণকারীর চিন্তাধারা সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে। হয়তো এটা নিজের আত্মজীবনীর মতো কিছু একটা। ফলোয়ারও বইটি হাতে পাবার জন্য হয়ত উদগ্রীব ছিলেন। বইটি প্রকাশের পর রাবা খানের ভাগ্যে জুটছে বাংলাকে অবজ্ঞার তীক্ষ্ম দোষারূপ। ফেসবুকের খোলামেলা জগাখিচুড়িকে তিনি এনেছেন বইমেলার বইয়ের পাতায়! বাংলা, ইংরেজি, বাংলিশ এমনকি হিন্দিকে ইংরেজি হরফে লিখতেও তিনি বাদ রাখেননি।

গ্রামের রাবেয়া খাতুন একন রাবা খান হয়ে গেছেন এখন। বাংলায় জন্মানো এই সেলেব্রিটি হয়তো লেখিকা হিসেবে নিজেকে জাহির করতে চেয়েছেন। চেয়েছেন আধুনিক শ্রেণিতে বিচরণকারীর চিন্তাধারা সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে। হয়তো এটা নিজের আত্মজীবনীর মতো কিছু একটা। ফলোয়ারও বইটি হাতে পাবার জন্য হয়ত উদগ্রীব ছিলেন। বইটি প্রকাশের পর রাবা খানের ভাগ্যে জুটছে বাংলাকে অবজ্ঞার তীক্ষ্ম দোষারূপ। ফেসবুকের খোলামেলা জগাখিচুড়িকে তিনি এনেছেন বইমেলার বইয়ের পাতায়! বাংলা, ইংরেজি, বাংলিশ এমনকি হিন্দিকে ইংরেজি হরফে লিখতেও তিনি বাদ রাখেননি।

কয়েকজন পাঠক তার বইটি পড়ে আমাকে জানান, ‘’কয়েক পাতা পড়ার পর আর রুচিতে কুলায়নি। ভাবছি টাকা ফেরত চাইবো।‘’ আরেকজন বলেন, ‘’ রাবা খান ১৫ পাতায় লিখেছেন, ‘’আমাকে ‘ওভার মেচিউরড’ বানানোর দোষ আমার বোনের বান্ধবী আনুষার মা যিনি ৭ বছরের বড় ছিলেন আমি তাকে দিবো।‘’ ১৭ তম পাতায় লিখেছেন, হিন্দি গান ‘বাদশা’ গাড়িতে বাজিয়ে তিনি ও আনুষা ঠোট মেলাতেন তখন ভাইয়া আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসি দিতেন। ‘’

আরেকজন পাঠক প্রশ্ন করতে গিয়ে বলেছেন, ৪৩ পাতায় রাবা খান লিখেছেন, ‘’ওখানে ৩টা চেয়ার ছিলো যার ২টা ইতিমধ্যে বুক করা তাই আমি ৩য়টায় গিয়ে বসি।‘’ -এটা আবার এত ঢং করে লেখার কি আছে? সেটা আমি বুঝিনি। তিনি আরো বলেন, ‘’ বয়স্ক মহিলাকে যেভাবে চেকআউটের বিবরণ দিয়েছেন তার দরকার ছিলোনা। ‘’

আরেকজন পাঠক তার ইংরেজি জ্ঞান নিয়েও প্রশ্ন করেছেন, ‘’নাহিয়ানকে বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘গর্জিয়াস’, ‘সুইট’; ছেলেরা ‘কুল’, ‘ড্যাশিং’, ‘হ্যান্ডসাম’ হয়। এটাও দেখি রাবা জানেনা।‘’

বইটির কয়েক পাতা পড়ার সৌভাগ্য আমারও হয়েছে তবে কয়েকটি পাতা পড়েই আমি যা বুঝতে পেরেছি তা হলো, বইটি রাবা খানের উচুশ্রেণির জীবনধারাকে উপজীব্য করে লেখা। যেখানে আছে ১৩ বছর বয়সের ইঁচড়ে-পাকা একটা মেয়ের (রাবা) বান্ধবীর সাথে বিয়ের পাত্র নির্বাচনে থাকার গল্প, আছে প্রতিবার যখন বান্ধবী বয়ফ্রেন্ডের সাথে ডেটে যায় তিনি সেসব ছেলেকে ভাইয়া ডাকেন তার বর্ণনা। আছে নুড লিপস্টিক দেওয়া ৫২-৫৩ বয়স্ক আন্টিকে চেকাউট! রয়েছে গাড়িতে বান্ধবীকে পেছনের সিটে বসিয়ে বান্ধবীর প্রেমিকের সাথে বসে বেলি ফুল বিক্রি করা ছেলেকে চমকে দেওয়ার গল্প।

মোট কথা বইটি আদৌ ছেলেদের নাকি ছেলে-মেয়ে নাকি শুধুমাত্র মেয়েদেরকে উদ্দ্যেশ্যে লেখা সেটাও স্পষ্ট নয়। কারণ এমন অনেক শব্দ আছে যা ছেলেরা জানার কথা নয়। বইটি পড়ে মনে হলো একটা বাচ্চা মেয়ের নিজেকে আল্টামর্ডাণ প্রমাণ করার জন্য কয়েকটা ঘটনাকে তুলে ধরেছে। যা তারা বয়সঃসন্ধিকালের স্মতিতে ধরে রাখে আর সেটাই উগড়ে দেওয়া। আর তসলিমা নাসরিনের মত অবাধ্মেলামেশা, নারীর প্রতি টান ইত্যাদিকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করার একটা প্রয়াস।

বাংলাপ্রধান এই বাংলাদেশে এমন বাংরেজি বই প্রকাশ পাওয়া বিক্রি এবং নিরবে থেকে যাওয়া বাংলাদেশির বাংলাকে অবজ্ঞা করার প্রকাশ্য নিদর্শন।

‘বান্ধobi’ কে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার দায় আসলেই কার? জবাবদিহিতা কার কাছে চাইবো?

বইমেলায় বাংলা একাডেমি পরিস্থিতি বিবেচনায় ‘ইসলাম বিতর্ক’ নামে একটি বই নিষিদ্ধ করেছিল খুব সম্ভবত ২০১৫ সালে। ২০১৬ সালে একুশে বইমেলার জন্য বিভিন্ন মেয়াদে নিষিদ্ধ করা হয়েছে পাঁচ প্রকাশনীকে। এর মধ্যে শ্রাবণ প্রকাশনী দুই বছর, বাকি চারটি নিষিদ্ধ হয়েছে পাঁচ বছরের জন্য। এগুলো হলো- ঐক্য, নীলপরী, রঙিনফুল ও ব-দ্বীপ প্রকাশনী। ১০ নভেম্বর ২০১৬ সালে বাংলা একাডেমির কাউন্সিলের সভায় শ্রাবণ প্রকাশনীকে বইমেলায় দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ২০১৭ তে একুশে বইমেলায় শতাব্দী ভবের বই ‘‘ভব’র চটি’’ নিষিদ্ধ করেছে বাংলা একাডেমি। এবারো নিষিদ্ধ হলো আরিফ আজাদের প্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ বইটা। আর বাংলা ভাষাকে অবমানননা করে বাংলিশে লেখা এই বই নিষিদ্ধ কেন করা হলোনা? তার জবাব দিতে হবে।

বইটি বাংলাতে প্রকাশিত হতে পারতো। থাকতে পারতো নারীদের ধর্ষণের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানোর কিছু পরামর্শের গল্প বা দুর্ঘটনায় কাউকে সাহায্য করার গল্প। রাবেয়া খাতুন থেকে রাবা খান হয়ে গড়ে ওঠার কেচ্ছা। নাহ! এসব কিছু স্থান পায়নি এই বইয়ে। স্থান পায়নি রক্তে অর্জিত বাংলা অক্ষর!
‘শিক্ষা নেওয়া’ বা ‘বিনোদন পাওয়া’ কিছুই নেই এই বইটাতে শুধুমাত্র কয়েকটা সমাজবিবর্জীত গল্প ছাড়া। এমন বই কীভাবে বেস্ট সেলার হতে পারে? যেখানে রয়েছে আরো দুইজন অনলাইন সেলেব্রিটি সোলাইনমান শুখনের মস্তিষ্কের ক্যানভাস এবং আয়মান সাদিকের ভাল্লাগেনা আর লেখক জাফর ইকবাল বা সাদাত হোসেন এর কথা তো বাদই দিলাম।

২০০৬ সালে অধ্যাপক জাফর ইকবাল কলামে লিখেছিলেন, ‘’আমি প্রতি বছর ভয়ে ভয়ে থাকি যে হয়তো কোনো একজন মানুষ এই বইমেলায় ইংরেজি অক্ষরে বাংলা লিখে একটা বই বের করে ফেলবে।‘’

তার আর বাকি রইলো কই?

বাংলা তথা শব্দকে রক্ষার জন্য সময়ের চাহিদা এখন ‘শব্দ অবমাননা মামলা’ এর প্রবর্তন এবং বাস্তবায়ন। লেখককে জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে এবং প্রকাশককে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে এবং বাংলা একাডেমিকে অবশ্যই আদালতের কাঠগোড়ায় জবাবদিহিতা করতে হবে। রকমারিকে আর্থিক জরিমানা করতে হবে এমন দাবিতে গোটা বাংলার নাগরিককে আজ সোচ্চার হবার আহবান জানাই। বাংলাকে অবজ্ঞা করে বইমেলাতে এমন বই প্রকাশ এবং বিক্রি জাতির জন্য অশনি সংকেত।

লেখকঃ জেনন জিহান
প্রতিষ্ঠাতা,
বাশু বানান শুদ্ধকারী

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *