Home » চান্দেও চিনে না, আমারে সূর্যেও চিনে না… সেই প্রমিথিউসের বিপ্লব এখন কোথায়

চান্দেও চিনে না, আমারে সূর্যেও চিনে না… সেই প্রমিথিউসের বিপ্লব এখন কোথায়

লম্বা চুল, আলখেল্লা পরা এক তরুণ মানুষের মনের কথাগুলো সোজাসাপ্টা সুরে সুরে বলে যেতে লাগলেন। সব বয়সী এবং সব শ্রেণির মানুষের মনে জায়গা করেও নিতে লাগল সেসব গান। ছোট থেকে বড় সবাই বলতে থাকল ‘এখন তো চান্দেও চিনে না, আমারে সূর্যেও চিনে না। চিনব কেমনে, যে চিনাইব সেও তো চিনে না’, মনের কথাগুলো এত সুন্দর করে বলে যাওয়া সেই মানুষটি বিপ্লব, প্রমিথিউস ব্যান্ডের বিপ্লব। খুব সহজে মানুষের মনের কথা, সমাজের নানা অসংগতির কথা সুরে সুরে বলে ছোট থেকে বড় সবার মন জয় করা বিপ্লবকে অনেক দিন ধরে দেশের কোনো মঞ্চে কিংবা টেলিভিশনে এমনকি রেডিওতে পাওয়া যায় না। তিনি আছেন যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে কী করছেন, আছেন কেমন?

গেল তিন বছর ব্যান্ড প্রমিথিউসকে স্টেজ শো এবং টেলিভিশনের কোনো অনুষ্ঠানে দেখা যায়নি। কোথাও নেই বিপ্লব। ফেসবুকে মাঝেমধ্যে উঁকি দেন। বিপ্লব এখন পরিবার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের কুইন্সে থাকেন। বড় ছেলে আদিব সেখানকার একটি স্কুলে টেনথ গ্রেডে আর মেয়ে তটিনী নাইনথ গ্রেডে পড়ে। ছোট ছেলে অ্যারন পড়ে কিন্ডারগার্টেনে।

ব্যান্ড, মিক্সড ও একক অ্যালবাম, স্টেজ শো—সব জায়গায় নব্বই দশকে দাপুটে বিচরণ ছিল বিপ্লবের। এলআরবি, নগরবাউলের পাশাপাশি হেঁটেছে প্রমিথিউস। ব্যান্ডে যেমন সরব ছিলেন, তেমনি আইয়ুব বাচ্চু , জেমস, হাসান ও বিপ্লব সমানতালে উচ্চারিত একটি নাম ছিল। নব্বই দশকে এই চার ব্যান্ড ও চার শিল্পীর সমান বিচরণে মুখরিত ছিল বাংলাদেশের গানের জগৎ।
কথায় কথায় বিপ্লব জানান, নিউইয়র্কে তিনি এখন ট্যাক্সি সার্ভিসের কাজ করছেন। বললেন, তিন বছর আগে নিউইয়র্কে গিয়ে তিনি প্রথম কাজ শুরু করেন আমেরিকান এয়ারলাইনসে। এক বছর পর গাড়ি কিনে ট্যাক্সি সার্ভিস শুরু করেন।

দেশের রক গানের জনপ্রিয় এই শিল্পী যুক্তরাষ্ট্রে ট্যাক্সি চালান—ভক্ত ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা শুনলেই হয়তো চমকে যেতে পারেন। তবে বিপ্লব এতে মোটেও বিচলিত কিংবা বিব্রত নন। তিনি যা, তা-ই সবার সামনে থাকতে চান।

বিপ্লব বলেন, ‘আমি ট্যাক্সি জবে আছি, বলতে সংকোচ বোধ করি না। আমি তো চুরি করছি না। মানুষকে সেবা দিচ্ছি, বিনিময়ে টাকা নিচ্ছি। আমেরিকা আসার পর আমার অনেক বড় অভিজ্ঞতা হয়েছে। বিদেশ বলতে আমরা দেশে বসে যা বুঝি, বিদেশ আসলে মোটেও তা না। আমেরিকার লাইফ আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে, অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, যা আমার পরবর্তী জীবনে কাজে দেবে।’

বিপ্লব গান-বাজনা থেকে দূরে সরে যাননি। বললেন, ‘আমার অস্তিত্বে গান।’ নতুন গান লিখছেন। নতুন গানের সুরও তৈরি করছেন। গেল তিন বছরে ৫টি নতুন গিটার কিনেছেন। ৪ বছর বয়সী ছোট ছেলে অ্যারনের জন্যও গিটার কিনে রেখেছেন। কাজের ফাঁকে বিপ্লব প্রায় দিনই গিটার নিয়ে প্র্যাকটিসে বসে পড়েন। জানিয়ে রাখলেন, সৃষ্টিকর্তা যদি শরীর-স্বাস্থ্য ভালো রাখে, ব্যান্ডের সবাইকে নিয়ে আবার গানের ময়দানে নামবেন। তবে কবে, তা এই মুহূর্তে বলতে পারছেন না। বললেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সবকিছু গুছিয়ে নেওয়ার পর আবার সাড়ম্বরে গান নিয়ে মেতে থাকবেন।’

করোনার এই সময়ে ট্যাক্সি সার্ভিস তো ঝুঁকিপূর্ণ। বাইরের লোকজন গাড়িতে ওঠে। পরিবারের নিরাপত্তা ঠিক থাকছে কি? ‘আমার ট্যাক্সি সার্ভিসের কাজ এখানকার একটি হাসপাতালের সঙ্গে। জরুরি প্রয়োজনে প্রায় দিনই বের হতে হয়। পরিবারের সবার নিরাপত্তার কথা ভেবে এই সময়টাই ওদের বাসার পাশেই এক রুমের বাসায় থাকছি। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে প্রতিদিনই দেখা হচ্ছে। কথা হচ্ছে।’

দেশে বিপ্লব তো ভালোই ছিলেন। কেন আপনাকে দেশের বাইরে যেতে হলো? ‌ ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে কথা না বলে বিপ্লব সরাসরি বললেন, ‘সৃষ্টিকর্তা জীবনের এই সময়টা এখানেই লিখে রেখেছিলেন, তাই আসতে হয়েছে।’

যে বিপ্লব স্টেজ শো নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন, তাঁকে এখন ট্যাক্সিতে করে লোকজনকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় দিয়ে আসতে হয়। এ নিয়ে অবচেতন মনেও কিছু উঁকি দেয়? ‘আমি যে লাইফ স্টাইল লিড করতাম, সেখান থেকে বেরিয়ে এসে এখন যে লাইফ লিড করছি, মানুষ হিসেবে এটাই বড় যোগ্যতা। যদি ভাবতাম, আরে ভাই আমি তো বাংলাদেশের বিপ্লব, এখানে এসে কী করছি! তখন কিন্তু আমি শেষ! মানে আমি ব্যর্থ-হতাশ হয়ে যাব। এই হতাশা আমাকে গ্রাস করবে। আমি মনে করি, দিস ইজ পার্ট অব লাইফ, আমি সময়টাকে উপভোগ করছি। আমি নতুন গান লিখছি, গানের মিউজিক করছি, কোনো কিছু কিন্তু থেমে নেই। নিজের একটা ইউটিউব প্ল্যাটফর্মও চালু করব, ভক্ত-শ্রোতারা প্রতিনিয়ত গান পাবেন।’

যুক্তরাষ্ট্রে ট্যাক্সি সার্ভিসকে কেন বেছে নিলেন? অন্য কোনো কিছু করার সুযোগ কি ছিল না? বিপ্লব বলেন, ‘আমি স্বাধীনমতো কাজ করছি। খবরদারি করার কেউ নাই। এখানে অন্য কাজ করব, আমার সেই সুযোগটাও তো নেই। স্মার্ট কিছু করতে হলে এখানকার পড়াশোনা লাগে। অভিজ্ঞতা লাগে। দেশের মাস্টার্স ডিগ্রি দিয়ে এ দেশে স্মার্ট কিছু করা যাবে না। এদিকে আরও পড়াশোনা করার সময় নেই, এখন পড়াশোনা করবে আমার ছেলেমেয়েরা। ওদেরকে তৈরি করছি। আমি হয়তো বিষয়টা না বললেও পারতাম, কিন্তু এসব লুকোচুরি আমার মধ্যে নেই। তাই ট্যাক্সি চালানোর বিষয়টিও লুকাইনি।’

বাংলাদেশ সংগীত কলেজের অধ্যাপক আবু তাহেরের ছেলে বিপ্লব ছোটবেলা থেকে গানের মাঝে বেড়ে ওঠেন। ১৯৯৬ সালে প্রমিথিউস ব্যান্ড গঠনের মধ্য দিয়ে পেশাদার সংগীতজীবন শুরু করেন। দুই বছরের মাথায় প্রকাশ করেন প্রথম অ্যালবাম ‘স্বাধীনতা চাই’। এরপর দলের হয়ে ১৬টি অ্যালবাম প্রকাশ করেছেন। একক গানেও বিপ্লব ছিলেন অনবদ্য। প্রমিথিউস ব্যান্ডের সর্বশেষ প্রকাশিত দুটি অ্যালবাম হচ্ছে ‘আমাদের পথ’ ও ‘ছায়াপথ’।

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *