অনলাইন ডেস্ক: রজনীকান্ত তার নাম মুখে নেওয়ার আগে প্রথমেই ‘স্যার’ সম্বোধন করেন তারকারা। কারণ তিনি তারকাদের তারকা। জীবনে বিচিত্র সব কাজ করেছেন। কখনও অফিস বয় কিংবা কাঠমিস্ত্রি, কখনও কুলি কিংবা বাস কন্ডাক্টর। বাসে টিকিট দেওয়া আর খুচরা টাকা ফেরানোর ভঙ্গি এতই জনপ্রিয় ছিল যে, যাত্রীরা তার বাসের জন্য অপেক্ষা করতেন। সেই তিনিই হয়ে গেছেন সিনেমার দেবতা। বলা যায়, তিনি হচ্ছেন চলমান বাস্তব সিনেমার গল্প। অভিনয় জীবনের পঞ্চাশ বছর পূর্ণ করেছেন চলতি মাসের ১৬ তারিখে। এর দুই দিন আগে মুক্তি পেয়েছে ক্যারিয়ারের ১৭১তম সিনেমা ‘কুলি’। বলা হচ্ছে ভারতীয় সিনেমার সুপারস্টার রজনীকান্তের কথা। স্বাভাবিক কারণে তার আগের সব ছবির সঙ্গে ‘কুলি’র রয়েছে বিস্তর পার্থক্য। এর পরিচালক লোকেশ কানাগরাজ, যিনি থালাপতি বিজয় অভিনীত সব অ্যাকশন বাণিজ্যিক সিনেমার জন্য পরিচিত। তিনিই সুপারস্টারকে নিয়ে এসেছেন একেবারে ভিন্নভাবে। এমনিতেই রজনীকান্ত অ্যাকশন সিনেমায় অদ্বিতীয়। তার ওপর এই বয়সে (৭৪ বছর) একাই এক ডজন শত্রুকে কাবু করে ফেলছেন, তা দেখে সিনেমা হলগুলো ভক্তদের করতালিতে ফেটে পড়ছে।
শুরুতেই বলা হয়েছে এই নায়কের জীবন কাহিনি অবিশ্বাস্য; যা সিনেমার গল্পকেও হার মানায়। ১৯৫০ সালের ১২ ডিসেম্বর শিবাজি রাও গায়কোয়াড় নামে জন্ম। চার ভাই-বোনের মধ্যে তিনিই ছিলেন কনিষ্ঠ। পুলিশ কনস্টেবল বাবার অবসরের পর পরিবার চলে যায় হনুমন্থ নগরে। মাত্র ৯ বছর বয়সে হারান মাকে। গাভিপুরম গভর্নমেন্ট কন্নড় মডেল প্রাইমারি স্কুলে পড়াশোনা করেন রজনীকান্ত। ছিলেন যেমন পড়াশোনায় মনোযোগী, তেমনি দুষ্টুমিতেও পটু। ক্রিকেট, ফুটবলের মতো খেলায়ও ছিল তার আগ্রহ। পরে ভাই তাকে ভর্তি করিয়ে দেন রামকৃষ্ণ মিশনে। সেখানেই অধ্যাত্মচর্চার প্রতি অনুরাগ তৈরি হয় আর অভিনয়ের প্রতি আগ্রহ জাগে। মঞ্চনাটকে অভিনয় করে শিক্ষক-সহপাঠীদের প্রশংসা কুড়ান। পরিবার প্রথমে আপত্তি জানালেও বন্ধুর সহায়তায় ভর্তি হন মাদ্রাজ ফিল্ম ইনস্টিটিউটে। সেখানেই পরিচালক কে বালাচন্দর তাকে নতুন নাম দেনÑ রজনীকান্ত। প্রথম দিকে ছিলেন খলনায়ক, পরে ‘বিল্লা’ (১৯৮০) দিয়ে প্রতিষ্ঠা পান অ্যাকশন হিরো হিসেবে। এরপর বলিউড, আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র, এমনকি আমেরিকান মুভি ‘ব্লাডস্টোন’-এও দেখা গেছে।
ক্যারিয়ারের পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে এক ভক্ত মধুরাইতে অবস্থিত রজনীকান্ত মন্দির ও অরুলমিগু শ্রী রজনী মন্দিরকে পাঁচ হাজার ৫০০টিরও বেশি ছবি দিয়ে সাজিয়েছেন। কয়েক বছর আগে উদ্বোধন হওয়া এই মন্দিরে রয়েছে ৩০০ কেজি ওজনের রজনীকান্তের একটি চমৎকার মূর্তি, যা অভিনেতার ভক্তদের গভীর আবেগের বহির্প্রকাশ বলা যায়। রজনীকান্ত এক সাংস্কৃতিক ঘটনাপ্রবাহ। তার জন্য নির্মিত হয়েছে মন্দির, প্রচারে ব্যবহৃত হয়েছে বিমান। শুধু ভারত নয়, দেশটির বাইরেও তার ভক্তের সংখ্যা অগণিত। রজনীকান্তের ভক্তরা কেবল সিনেমা দেখেই ক্ষান্ত নন, অনেকেই সামাজিক সেবামূলক কাজও করেন প্রিয় তারকার নামে। রক্তদান, ত্রাণ বিতরণ, কমিউনিটি অনুষ্ঠানÑ সবই চলে তারকাপূজার অংশ হিসেবে। ছবির মুক্তির দিন হয়ে ওঠে উৎসবÑ দুধ দিয়ে মূর্তি স্নান, পুষ্পবৃষ্টি, আতশবাজি আর ভোর থেকে সারিবদ্ধ অপেক্ষা। পাঁচ দশকের এই অসামান্য যাত্রা উদযাপন করছে লাখো ভক্ত, ৫০,০০০-এর বেশি ফ্যান ক্লাব আর গোটা ভারতীয় সিনেমা।
৪০০ কোটি রুপি বাজেটের ‘কুলি’ ছবিতে সব রসদ ভরপুর রেখেছেন পরিচালক লোকেশ কানাগরাজ। তামিল এই ছবিতে একদিকে দেখা গেছে ‘থালাইভা’ রজনীকান্তের ‘সোয়াগ’, অপরদিকে দক্ষিণি সুপারস্টার নাগার্জুন আক্কিনেনিকে নতুন রূপে। ‘কুলি’তে অতিথিশিল্পী হিসেবে হাজির হয়েছেন বলিউড সুপারস্টার আমির খান। ছবিতে চরিত্রটি ছোট হলেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পূজা হেগড়ের শিহরণজাগানো আইটেম নাচ আর শ্রুতি হাসানের নজরকাড়া সৌন্দর্যের পাশাপাশি পরিশীলিত অভিনয় সিনেমার অন্যতম সম্পদ। মুক্তির প্রথম দিনে এই অ্যাকশন-ড্রামাধর্মী ছবিটি বক্স অফিসে ভালোই প্রদর্শন করেছিল। গত বৃহস্পতিবার আয় ছিল ৬৫ কোটি রুপি। মুক্তির দ্বিতীয় দিন, অর্থাৎ শুক্রবার ‘কুলি’র বক্স অফিস আয় ৫৩ কোটি ৫ লাখ রুপি। তিন দিনে এই ছবির আয় বিশ^জুড়ে ৩০০ কোটি ছাড়িয়ে গেছে।
প্রথম ভারতীয় অভিনেতা হিসেবে রজনীকান্ত অ্যানিমেশন ও থ্রিডি সিনেমায় অভিনয় করেছেন। লেখক এবং প্রযোজক হিসেবেও তিনি নাম লিখিয়েছেন। তামিল এই সুপারস্টারের সিনেমা মুক্তির দিন অফিস-আদালত ফাঁকা হয়ে যেত। তাই বাধ্য হয়ে সেই দিনগুলোতে ছুটি ঘোষণা করত কর্তৃপক্ষ। দক্ষিণ ভারতের সিনেমাপ্রেমীদের কাছে রজনীকান্ত মানেই জীবনের অনুষঙ্গ। দক্ষিণ ভারতের মানুষের ঘরে ঘরে বাঁধাই করা পোস্টারে দেখা যায় রজনীকান্তকে। অথচ মজার ব্যাপার হচ্ছে, জনপ্রিয় এই অভিনেতা জন্মসূত্রে তামিল নন। তার জন্ম হয়েছিল বেঙ্গালুরুতে। ভারতসহ বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে আছে তার ভক্ত। সব সময় তিনি ভক্তদের অনুপ্রাণিত করতে চান। দর্শকের সঙ্গে সহজভাবে মিশে যাওয়ার অসাধারণ এক ক্ষমতা আছে রজনীকান্তের।
প্রতিনিধি