পর্যটন নগরের নাম শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে সিলেটের টিলাবেষ্টিত চা-বাগান, পাহাড়, পাথর ও জাফলংয়ের স্বচ্ছ পানি। পর্যটকদের অন্যতম পছন্দের স্থান এই জনপদ। এ ছাড়া প্রকৃতিপ্রেমীদের সব সময় টানে রাতারগুল, জাফলংয়ের মায়াবী ঝরনা, লালাখালের নীল পানি আর জৈন্তাপুরের রংপানি।
দুটি পাতা একটি কুঁড়ির নয়নাভিরাম চারণভূমির শহর সিলেট, হযরত শাহজালাল (রহ.) ও হযরত শাহপরান (রহ.)সহ ৩৬০ আউলিয়ার পুণ্যভূমি সিলেট এবং গোলাপগঞ্জে রয়েছে শ্রী চৈতন্যের তীর্থস্থান। এ ছাড়া সিলেটের আনাচকানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে প্রকৃতির রূপ-লাবণ্যের অপূর্ব সৌন্দর্যের ভান্ডার। এখানকার নৈসর্গিক প্রকৃতির শোভা যে কাউকে মুগ্ধ করে অতি সহজে। ইতোমধ্যে পযর্টকদের আগামনে সরগরম হয়ে উঠেছে প্রাকৃতিক এত উপাদানের এই জনপদ।
সিলেট এমনিতেই গ্যাস আর তেলের মতো প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। এ ছাড়া বাউল আর মরমি গানের মনমাতানো ঢেউ রয়েছে এই বিভাগে। এখানে জন্মেছেন মরমি কবি হাসন রাজা, রাধা রমন দত্ত, আরকুম শাহ, দূরবীন শাহ ও শাহ আব্দুল করিমের মতো সাধকরা। আর সিলেট নগরের ঘাইপাড়াকে বলা হয় বেতের বাক্সেট। ঈদে এসব দর্শনীয় স্থানেও পর্যটকদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো।
সিলেটের জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান জানান, ঈদের ছুটিতে আধ্যাত্মিক ও পর্যটন নগরের এই সিলেটে হাজার হাজার পর্যটক ঘুরতে আসেন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে। তাদের নিরাপত্তাসহ সার্বিক বিষয়ের ওপর নজর রাখতে ইতোমধ্যে বিজিবি, পুলিশ ও সিভিল অ্যাভিয়েশনসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কেউ কোনও বিশৃঙ্খলা কিংবা পর্যটকদের হয়রানি করার চেষ্টা করলে সঙ্গে সঙ্গে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া আছে।
সিলেট জেলা পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, পর্যটকদের যাতে কেউ হয়রানি না করতে পারে, সে জন্য তৎপর রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সেই সঙ্গে পর্যটন এলাকাগুলোয় পুলিশের নজরদারিও বাড়ানো হয়েছে।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি এই অঞ্চল। পাহাড়, পানি, পান, পাথর, ঝরনা—সব মিলিয়ে সিলেট যেন রূপকথার রাজ্য। এ ছাড়া বিছনাকান্দি, পান্তুমাই, জাফলং, রাতারগুল, লালাখাল, জায়লংয়ের মায়াবী ঝরনা, তামাবিল, পাথরের রাজ্য, মাজার, ঈদগা, মন্দির—কী নেই সিলেটে?
ভারতের মেঘালয় পাহাড়। পাহাড়ের বুক চিরে বয়ে এসেছে মনোলোভা কয়েকটি পাহাড়ি ঝরনা। পাহাড়ের ওপার থেকে কলকল শব্দে ঝরনার ধারায় চলে এসেছে গোয়াইনঘাটের পিয়াইন নদীতে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে বিছনাকান্দি। অবিশ্বাস্য সৌন্দর্যের সমাহার বিছনাকান্দির সৌন্দর্য বিস্ময়কর। কাছেই দাঁড়িয়ে দেখা যায়, মেঘে ঢাকা মেঘালয় পর্বতমালা আর সে পাহাড় থেকে প্রবাহিত সুশীতল ঝরনাধারার তীব্র প্রবাহ। হাতের কাছে দেখা যাবে আকাশে হেলানো উঁচু উঁচু পাহাড়ের সারি। চোখ-ধাঁধানো সব দৃশ্য দেখতে দেখতে একসময় এই পাহাড়ের কোলে এসে চোখে পড়বে বিস্তীর্ণ পাথর কোয়ারি।
বিছনাকান্দির পাশেই অপরূপ সৌন্দর্যের ওপর পাহাড়ি ঝরনা আপনাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। নাম তার পান্তুমাই। এখানে পাহাড় নদীর আর ঝরনা সাজিয়ে বসে আছে মনরোম পরিবেশ নিয়ে।
যারা সৌন্দর্যপিপাসু, তাদের পক্ষে জাফলংয়ের আকর্ষণ এড়ানো কিছুতেই সম্ভব নয়। সিলেটের পর্যটনের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ এই জলপ্রপাত। ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায়, এ চিত্র দেখতে হলে যেতে হবে জাফলংয়ে। এখানে দূর থেকে তাকালে মনে হবে আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়। প্রকৃতিকন্যা নামেও রয়েছে আলাদা পরিচিতি। ওপারে খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়, এপারে নদী। পাহাড়ের বুক চিরে বয়ে চলছে ঝরনা, আর নদীর বুকে স্তরে স্তরে সাজানো নানা রঙের নুড়ি পাথর। পাহাড়ের গায়ে নরম তুলার মতো ভেসে বেড়াচ্ছে মেঘরাশি। প্রকৃতির এই অপরূপ সৌন্দর্য আর কোথায় পাবেন জাফলং ছাড়া? এখানেই শেষ নয়, সমতল চা-বাগান, খাসিয়াপল্লি, পানের বরজ।
সিলেটের গোয়াইনঘাটের রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট। ভরা বর্ষায় মাথার ওপর সূর্য দেখা দিলে ঈষৎ ছায়াজলে এক অপূর্ব রূপ ধারণ করে রাতারগুল। কাচের মতো মসৃণ নিথর জলে গাছের ডালপালার প্রতিবিম্ব এক অদ্ভূত দৃশ্যের অবতরণা করে। তখন হঠাৎ কোনও বন্য প্রাণী অজগর, কাঠবিড়ালি, বানর, বনবিড়াল, শিয়াল পাতার ছায়ার জলে উঁকি দেয়। জালিবেত, কদম, হিজল, মূর্তাসহ নানা জাতের গাছে সমৃদ্ধ এই বন।
সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলায় স্বচ্ছ নীল পানির নদী ‘লালাখাল’। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপরূপ লীলাভূমি। প্রকৃতিকে একান্তে অনুভব করার জন্য স্থানটি বেশ উপযোগী। পাহাড়ে ঘন সবুজ বন, নদী, চা-বাগান ও নানা জাতের গাছের সমাহার লালাখালজুড়ে। ভারতের চেরাপুঞ্জির ঠিক নিচেই লালাখালের অবস্থান। চেরাপুঞ্জি পাহাড় থেকে উৎপন্ন এই নদী বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। লালাখালের চারপাশে সন্ধ্যার আগ মুহূর্ত হয় আরও অবিস্মরণীয়। ওপরে আলোকিত আকাশ। ক্লান্ত সূর্য ঢলে পড়ে পশ্চিম আকাশে। এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য।
প্রকৃতিকন্যা জাফলংয়ে যাওয়ার আগেই রয়েছে মায়াবী ঝরনা। এটি এক পলক দেখতে ভিড় জমান শত শত পর্যটক। জাফলংয়ের জিরো পয়েন্ট থেকে পশ্চিমে খাসিয়া জৈন্তিয়া পাহাড়ের গায়ে বহমান এই ঝরনা। বিশাল আকারের এই ঝরনা থেকে দেখতে পাওয়া যায় আদিবাসী খাসিয়াদের বসতি সংগ্রাম পুঞ্জি, নকশিয়ার পুঞ্জি ও লামা পুঞ্জি।
সুদূর ইয়েমেন থেকে ধর্ম প্রচারের জন্য এ দেশে এসেছিলেন সাধক পুরুষ হযরত শাহজালাল (রহ.)। দীর্ঘদিন সিলেটে বিভিন্ন মানুষের মাঝে ৩৬০ জন আউলিয়াসহ ধর্ম প্রচারের কাজে নিয়োজিত ছিলেন তিনি। প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক পর্যটক সিলেটে আসেন তার মাজার জিয়ারতে। হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর ব্যবহৃত কতগুলো মূল্যবান পবিত্র দ্রব্যও মাজারের সন্নিকটে অতীব যত্নের সঙ্গে সংরক্ষিত আছে আজও।
তামাবিল সিলেট শহরের প্রায় ৫৮ কিলোমিটার উত্তরে সিলেট-শিলং (ভারত) যাতায়াত পথের প্রান্তসীমায় চমৎকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে অবস্থিত। মনোমুগ্ধকর পর্বতের দৃশ্য ছাড়াও তামাবিলের প্রান্তসীমা থেকে জলপ্রপাত দেখা যায় ক্ষীণভাবে। প্রতিদিন ভারত থেকে অসংখ্য ট্রাক স্থলপথে এই বন্দরে কয়লা নিয়ে আসার কারণে বাংলাদেশ বছরে কয়েক কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করে থাকে। এ ছাড়া এখানকার স্থলপথেও অনেক বিদেশি পর্যটক বাংলাদেশে আসেন।
পর্যটন নগরী সিলেট হিন্দু ধর্মাবলম্বীদেরও অন্যতম তীর্থভূমি। শহরের মধ্যেই বেশ কয়েকটি ঐতিহ্যবাহী গুরুত্বপূর্ণ মন্দির রয়েছে। প্রতি বছর শত শত পর্যটক এখানে ভ্রমণে এসে আত্মশুদ্ধি লাভ করেন।
একটি সমৃদ্ধ, ঐতিহ্যবাহী জনপদ জৈন্তারাজ্য একসময় ছিল প্রাচীন নারী রাজ্য। প্রবাদ আছে: ‘পান, পাতা আর নারী—এই তিন নিয়েই সিলেটের জৈন্তাপুর’।ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দশন এখনও টিকে আছে জৈন্তা রাজবাড়িতে। সময়ের পরিক্রমায় রাজবাড়ি এবং ফটক ধ্বংসের প্রায় দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত হলেও এখনও ইতিহাস ও ঐতিহ্যপ্রিয় পর্যটকরা এখানে সময় কাটাতে পছন্দ করেন। এ ছাড়া অক্ষত অবস্থায় আছে বধ্যভূমিও। এখানেই অবাধ্যদের হত্যা করা হতো। জৈন্তা রাজবাড়ি ঐতিহাসিক পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে সিলেটের পর্যটনশিল্পে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে।
পাথর-রাজ্য ভোলাগঞ্জ
পাথর ছুঁয়ে নামছে পাহাড়ের স্বচ্ছ জল, সেই জলে বাসা বেঁধেছে সাদা পাথর। এর সঙ্গে আছে নীল আকাশ আর পাহাড়ের বুকে কালো মেঘের আনাগোনা। যাত্রাপথেই চোখে পড়বে বালির পাহাড় আর সারি নৌকা।
বার্তা বিভাগ প্রধান