Home » ব্যর্থ প্রেমের কাহিনী- বাকরখানি

ব্যর্থ প্রেমের কাহিনী- বাকরখানি

ডেস্ক নিউজ:  রমজান এলে সিলেটে বেড়ে যায় বাকরখানির কদর। ইফতারের খাদ্যতালিকার এক আবশ্যিক আইটেম বাকরখানি। তাই নগরীর ইফতারির দোকানগুলোতে বাকরখানির চলছে রমরমা কেনাবেচা। বাকরখানি মোঘল আমলের এক বিশেষ ধরণের রুটি যা ময়দা দিয়ে তৈরি। পুরান ঢাকাবাসীর কাছে এটি সকালের নাস্তা হিসেবে বহুল প্রচলিত। বছরজুড়েই সিলেটে বাখরখানি বিক্রি হয়। তবে রমজানে তা বেড়ে যায় কয়েকগুণ।  অনেক ঐতিহাসিকদের মতে, আঠারো শতাব্দির মাঝামাঝি সময়ে আফগানিস্তান বা এর আশপাশের অঞ্চলে খাদ্য হিসেবে বাকরখানির প্রথম প্রচলন শুরু হয়।  আবার অনেকের মতে, বাকের ও খনির ব্যর্থ প্রেমের কাহিনী থেকেই বিশেষ এই রুটির নাম বাখরখানি হয়েছে। রমজান শুরু হওয়ার পর থেকে নগরীর বিভিন্ন ধরণের ছোট-বড় রেস্তোরা, অভিজাত হোটেল এমনকি রাস্তার পাশের অস্থায়ী ইফতারির দোকানগুলোতে বাকরখানি বিক্রি হতে দেখা যায়। বিভিন্ন রেস্টুরেন্টভেদে এর মূল্য ৫ টাকা থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত রাখা হয়।
সিলেটের একাধিক রেস্টুরেন্টের মালিক ও বিক্রয়কর্মীরা জানান, সারা বছরই বাকরখানি বিক্রি করলেও রমজান মাসে এর চাহিদা থাকে প্রায় কয়েকগুণ। সবচেয়ে বেশি চাহিদা মিষ্টি বাকরখানির। তবে যাদের ডায়াবেটিস তাদের জন্য আছে মিষ্টি ছাড়া বাকরখানি। এছাড়া আমরা সবজি বাকরখানিও বিক্রি হয়। তাঁরা আরও জানান, বর্তমানে খাবারের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল মেশানো থাকে যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু বাকরখানিতে কোনো ভেজাল নেই। আর ভেজাল থাকলেও আগুনে পুড়ে ভেজালমুক্ত হয়ে যায়। এর দামও সবার সাধ্যের মধ্যে। বাকরখানি পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খাবার হলেও সিলেটবাসীরা এটিকে নিজেদের খাবার করে নিয়েছেন।
নগরীর টিলাগড়ে একটি রেস্টুরেন্টে বাকরখানি কিনতে আসা মারিয়াম জান্নাত মৌমী  বলেন, ইফতারের পর চায়ের সাথে বাকরখানি খেতে খুবই ভালো লাগে। এতে একটা সতেজতাভাব আসে সারাদিন রোজা রেখে। ক্লান্তি শেষে বা বৃষ্টির সময় চায়ের সাথে বাকরখানি খেতে খুব ভালো লাগে। আবার রোজা ছাড়া সকালে বা সন্ধ্যার পর গল্প করতে করতে বাকরখানি আর চা খাওয়ার মজাই আলাদা। বাকরখানির প্রচলন নিয়ে নানা মতভেদ আছে। আগা বাকের খাঁ ও খনি বেগমের ব্যর্থ প্রেমের কাহিনী থেকেই এ রুটির নামকরণ বাকরখানি করা হয় বলে জানা যায়। নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর ছেলে আগা বাকের খাঁ ছিলেন প্রখর মেধার অধিকারী। যুদ্ধবিদ্যাতেও পারদর্শী ও প্রসিদ্ধ ছিলেন তিনি। রাজধানী মুর্শিদাবাদের এক নর্তকী খনি বেগমের প্রেমে পড়েন আগা বাকের খাঁ। এক সময় তাঁরা একে অপরকে ভালোবাসেন। কিন্তু তাতে বাঁধ সাধেন উজির জাহান্দার খাঁর পুত্র জয়নাল। তিনিও ভালোবাসতেন খনি বেগমকে। জয়নাল খনি বেগমকে প্রেম নিবেদন করলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে জয়নাল খনি বেগমের ক্ষতি করার চেষ্টায় উঠেপড়ে লাগে। এ খবরটি জানতে পারেন আগা বাকের খাঁ। তিনি জয়নালকে তলোয়ারযুদ্ধে পরাজিত করেন। এ সময় জয়নালের দুই বন্ধু তাঁর পিতাকে মিথ্যা সংবাদ দেন যে বাকের খাঁ জয়নালকে হত্যা করে লাশ গুম করেছেন। উজির তখন নবাবের কাছে ছেলে হত্যার বিচার চান।

ইতিমধ্যে জয়নালে মৃত্যুর খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এই সুযোগে জয়নাল খনি বেগমকে তোলে নিয়ে দক্ষিণবঙ্গে পালিয়ে যান। হত্যার দায়ে নবাব মুর্শিদকুলি ছেলে বাকের খাঁকে শাস্তিস্বরূপ বাঘের খাঁচায় নিক্ষেপ করেন। আগা বাকের খাঁ এতোই শক্তিশালী ছিলেন যে তাঁর হাতে খাঁচার বাঘের মৃত্যু ঘটে। খাঁচা থেকে বেরিয়ে বাকের খাঁ খনি বেগমকে উদ্ধার করতে যান। তাঁর পিছু নেন উজির জাহান্দার খান। এ সময় জয়নাল বাকের খাঁকে হত্যার চেষ্টা করলে উজির নিজের ছেলেকে তলোয়ার দিয়ে আঘাত করেন। আহত জয়নাল খনি বেগমকে তলোয়ার দিয়ে হত্যা করে। পরে তিনিও মৃত্যু কোলে ঢলে পড়ে। বাকেরগঞ্জে সমাধিস্থ করা হয় খনি বেগমকে। আর বাকের খাঁ সবকিছু ত্যাগ করে প্রিয়তমার সমাধির কাছে দক্ষিণবঙ্গে চলে যান। বাকের খাঁর নামানুসারেই বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ (পটুয়াখালী-বরিশাল) অঞ্চলের নাম হয় বাকেরগঞ্জ। ঐতিহ্যবাহী রুটি বাকরখানির নামকরণের পেছনে এই হচ্ছে বাকের-খনির প্রেমের ইতিহাস।

বাকরখানির নামকরণে আরেকটি জনশ্রুতি বিদ্যমান। মির্জা আগা বাকের খাঁ বৃহত্তম বরিশালে জায়গীরদার ছিলেন। আরামবাগের নর্তকী খনি বেগম ছিলেন তাঁর প্রেয়সী। কথিত আছে তাদের মধ্যে গভীর প্রেম ছিল। পরবর্তীতে আগা বাকের দ্বিতীয় মুর্শিদকুলি খাঁর কন্যাকে বিয়ে করেন। কিন্তু খনি বেগমের স্মৃতি তিনি তখনো ভুলতে পারেন নি। তাঁর আবিষ্কৃত ও প্রিয় খাদ্য বিশেষভাবে তৈরি এ রুটি ও তাদের প্রেমকাহিনীর ওপর ভিত্তি করেই এ রুটির নামকরণ করা হয়েছিল বাকের-খনি-রুটি। পরবর্তীতে এই নাম বিবর্তিত হয়ে বাকরখানি রূপ ধারণ করে।

বাকরখানি ময়দা দিয়ে তৈরি রুটি জাতীয় খাবার বিশেষ। এটি একটি গোলাকৃতির রুটি যা তৈরি করা হয় প্রধানত ময়দা বা গম, দুধ, লবণ, ডালডা, ঘি, পনির এবং খামির দিয়ে। রুটি বানিয়ে তা মচমচে বা খাস্তা করে ভেজে বাকরখানি তৈরি করা হয়। বাকরখানি রসালো ও সুমিষ্ট হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাকরখানি প্রস্তুত প্রণালিতে যোগ হচ্ছে নতুন নতুন উপাদান। সাধারণত ময়দা, সোডা, ডালডা দিয়ে বিভিন্ন ধরনের বাকরখানি তৈরি করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে ছানা, পনির, চিনি, নোনতা, কাবাব, কিমা ও নারিকেলের সংমিশ্রণে তৈরি বাকরখানি। এ ছাড়া গরু ও খাসির মাংসের ঝুরা দিয়েও এক ধরনের বাকরখানি তৈরি করা যায়, যা অত্যন্ত সুস্বাদু। মাংসের ঝুরার বাকরখানি সাধারণত ঈদের সময় অর্ডার দিয়ে তৈরি করা হয়। আবার ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য তৈরি করা হচ্ছে নোনতা বাকরখানি।

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *