Home » মোবাইল সিম ক্লোন হলে কী হবে

মোবাইল সিম ক্লোন হলে কী হবে

ডেস্ক নিউজ: সরকারের মন্ত্রী, এমপি, সচিব, পুলিশের আইজি, জেলা প্রশাসকদের মোবাইল নম্বর কপি তথা ক্লোন করে একশ্রেণির প্রতারক প্রতারণা করছে। গত এপ্রিলে গোপালগঞ্জ ও কুমিল্লার জেলা প্রশাসকের মোবাইল নম্বর ক্লোন করে প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এছাড়াও মার্চ মাসে কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসকের নম্বর থেকে বিভিন্নজনের কাছে ফোন করা হয়। যাদের ফোন করা হয় তারা ধরে নিয়েছিলেন জেলা প্রশাসকই তাদের সঙ্গে কথা বলছেন। এমন ঘটনা এখন প্রায়ই ঘটছে। মোবাইল সিম (সাবস্ক্রাইবার আইডেন্টিফিকেশন মডিউল) কার্ডের অবিকল প্রতিরূপ তৈরিই হলো সিম ক্লোনিং। অন্যের মোবাইল নম্বরের মতো নম্বর বানিয়ে পরিচিতজনদের ফোন করা বা দায়িত্বশীল কোনও ব্যক্তির নম্বর কপি করে ফোন করে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা আদায়ের ঘটনা এখন দেশে আর নতুন নয়। সম্প্রতি এ ধরনের একাধিক ঘটনার কথা জানা গেছে। প্রতারণা, টার্গেট করে কোনও ব্যক্তির মোবাইল সিমের তথ্য সংগ্রহ বা চুরি, ছিনতাই করে মোবাইল সিম নিয়ে ক্লোন করে প্রতারণা, হুমকি, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালানোর ঘটনাও ঘটছে সিম ক্লোনিংয়ের মাধ্যমে। এছাড়া ক্লোন করা সিম দিয়ে (মোবাইল নম্বর) এসএমএস বা কল-লগ অথেনটিকেশন নির্ভর যে কারও ফেসবুক আইডি, ইন্সটাগ্রাম ইত্যাদি হ্যাক করা সম্ভব। অন্যদিকে, মেসেজিং অ্যাপ আইএমও, ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপের মতো সেবা দখলে নিয়ে নিতে পারবে প্রতারকরা। অতি সম্প্রতি ছবি শেয়ারের অ্যাপ ইন্সটাগ্রামে ত্রুটি ধরা পড়েছে। বলা হচ্ছে ক্লোন করা সিম দিয়ে ইন্সটাগ্রামের দখল নেওয়া যাবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিম ক্লোন করে প্রতারকরা এখন আর শুধু হুমকি ধমকিতেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং ওটিটি (ওভার দ্য টপ) সেবা তথা মেসেজিং অ্যাপসেও নজর রাখছে। সুযোগ পেলেই ভার্চুয়াল দুনিয়ায় ব্যক্তির ইমেজ ও সামাজিক অবস্থানও ধ্বংস করতে পারে। রাষ্ট্রের জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে সিম ক্লোনকারীরা। সচেতন থাকলে সিম ক্লোন হলেও অল্প সময়ের মধ্যে সংশ্লিষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির পক্ষে তা বোঝা সম্ভব। আর বুঝতে পারলে একটি সিম দিয়ে বেশিক্ষণ অপরাধমূলক বা অন্য কাজ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না বলে জানিয়েছেন প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বাজারে এমন প্রযুক্তি রয়েছে, যা ব্যবহার করে প্রতারকরা মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যে সিম ক্লোন করতে পারে। তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ নেটওয়ার্ক অপারেটরস গ্রুপের (বিডিনগ) ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান সুমন আহমেদ সাবির বলেন, মোবাইল ফোনের সিম হলো একটি প্রোগ্রামেবল চিপ। মোবাইল সিমের তিনটা ভার্সন রয়েছে। এরমধ্যে দুটো ভার্সন (ভার্সন ২ ও ৩) এককভাবে সিকিউরড। ভার্সন ১ অপেক্ষাকৃত দুর্বল। সিম ক্লোনিংয়ের যত ঘটনা এখন পর্যন্ত ঘটেছে তার সবই ভার্সন ১-এর সিমে। তিনি জানান, এখন যত সিম ব্যবহার হয় তার মধ্যে ৭০ ভাগ হলো ভার্সন ১-এর সিম। এই সিম কপি করা যায়। বাজারে সিম কপির সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার পাওয়া যায়। যা দিয়ে সিম কপি করা সহজ। আর কপির কারণে দুর্ঘটনা ঘটেও বেশি।

তার জানা মতে, ভার্সন ২ ও ৩-এর নিরাপত্তা দেয়াল এখনও কেউ ভাঙতে পারেনি। তিনি মনে করেন, সিম ক্লোনিং রোধে সবার উচিত মোবাইল সিম হালনাগাদ করে নেওয়া। নতুন সিম তথা থ্রিজি বা ফোরজিতে ভার্সন ২ ও ৩ ব্যবহার করা হয়েছে। যারা পুরনো তথা অনেকদিন ধরে একই সিম ব্যবহার করছেন তারা যদি নতুন মোবাইল সিম (ফোরজি) তুলে ব্যবহার করেন তাহলে ফোন বেহাত হলেও কোনোভাবে সিম ক্লোন করা সম্ভব হবে না। সিম ক্লোনিং কীভাবে সংঘটিত হয় জানতে চাইলে সুমন আহমেদ সাবির বলেন, কোনও ব্যক্তিকে টার্গেট করে যদি তার সব তথ্য (সিমে যা আছে) সংগ্রহ করা যায় তাহলে সফটওয়্যার দিয়ে সিম ক্লোন করা যাবে। পরিকল্পিতভাবে কোনও ব্যক্তির সিম সংগ্রহ করেও (চুরি, ছিনতাইয়ের মাধ্যমে) সিম কপি করা যায়। এছাড়া সংশ্লিষ্ট মোবাইল ফোন অপারেটরের নির্দিষ্ট শাখায় কর্মরতরা গ্রাহকের তথ্য নিয়েও অপব্যবহার করতে পারেন। জানা গেছে, বেশি দিন ধরে একটি সিম ব্যবহার করলে তার নিরাপত্তা ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে। ২ ও ৩ ভার্সনের সিমের নিরাপত্তা ব্যবস্থা যতদিন কেউ ভাঙতে পারবে না ততদিন এই সিম নিরাপদ। এক প্রশ্নের জবাবে সুমন আহমেদ সাবির বলেন, সিম ক্লোন হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির পরিচয় সংকট তৈরি হয়। ক্লোন করা হলে সিমের প্রতিরূপ তৈরি হয়ে যায়। ফলে কপি নম্বরও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির পরিচয় বহন করে। ফলে তখন মুখ্য হয়ে দাঁড়ায় কে আসল। আর এই সুযোগ নিয়ে অপরাধীরা হুমকি-ধমকি দেওয়া, চাঁদাবাজি করা, সন্ত্রাসমূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া, জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়া, আত্মীয়, বন্ধু-স্বজনদের কাছে টাকা ধার চাওয়া, বিখ্যাত বা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির পরিচয় দিয়ে বড় কোনও কাজ করিয়ে নেওয়াসহ বিভিন্ন ধরনের কর্ম সম্পাদন করতে পারে। কোনও ক্লোন সিম দিয়ে অপরাধ করলে ব্যক্তির পক্ষে পার পাওয়া বেশ কঠিন। কোনোভাবে যদি প্রমাণ করা যায় সিম ক্লোন হয়েছিল তাহলে ছাড়া পাওয়া গেলেও যেতে পারে। তবে তা নির্ভর করে উপযুক্ত সাক্ষ্য প্রমাণের ওপর। যারা সিম ক্লোনিংয়ের সঙ্গে জড়িত, উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে তাদের চিহ্নিত করা মুশকিল।  তথ্যপ্রযুক্তি গবেষণা বিষয়ক প্রতিষ্ঠান প্রেনিউর ল্যাবের প্রধান নির্বাহী এবং ফেসবুক ও গুগলের সাবেক কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার আরিফ নিজামি  বলেন, যারা মোবাইল ফোন ব্যবহারে সচেতন নন তারা সিম ক্লোনিংয়ের শিকার হলে বেশি বিপদে পড়বেন। যারা এসএমএস বা কল-লগ দিয়ে অথেনটিকেশন যাচাই করেন, তাদের সিম ক্লোন হলে হ্যাক হতে পারে তার ই-মেইল আইডি। ভুয়া আইডি খুলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেকোনও ধরনের অনিষ্ট সাধন করতে পারে। ব্যক্তির চরিত্র হননের মতো কাজও করতে পারে প্রতারকরা। আরিফ নিজামি আরও বলেন, মেসেজিং অ্যাপ, যেমন- আইএমও, ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপ মোবাইল নম্বরের ওপর নির্ভরশীল। নম্বর ক্লোন করে যে কেউ এসব অ্যাপে প্রবেশ করে (হোয়াটসঅ্যাপ বাদে) ব্যক্তির পুরনো কথাবার্তা (চ্যাট) পড়তে পারে। এটা ভয়ঙ্কর ঘটনার জন্ম দিতে পারে। তার পরামর্শ, টু-ওয়ে অথেনটিকেশন (ব্যাকআপসহ) ব্যবস্থা নিরাপত্তার জন্য রাখা হলে সিম ক্লোন হলেও ব্যক্তির ক্ষতি করতে পারবে না প্রতারকরা। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, প্রতারকরা তখন মোবাইলে অথেনটিকেশনের পাসওয়ার্ড পাঠালেও আরেকটি অথেনটিকেশন ব্যবস্থা সক্রিয় থাকায় (তিনটি প্রশ্নের উত্তর বা ৫ জন বন্ধুকে চিহ্নিত করা) আইডি হ্যাক করা বা অন্য কোনও অনিষ্ট সাধন করা সম্ভব নয়। তবে মেসেজিং অ্যাপের ক্ষেত্রে আরও সতর্ক ও নিরাপদ ব্যবহারের ওপর তাগিদ দেন তিনি। অন্যদিকে সিম তথা প্রোগ্রামেবল চিপ তৈরির সঙ্গে জড়িত একটি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সিম ক্লোনিং ব্যক্তির আত্মপরিচয়ের সংকট তৈরি করে। যিনি ক্লোন করা সিমের কল পান তিনি মনে করেন সংশ্লিষ্ট নম্বর ব্যবহারকারীই ফোন করেছেন। ফলে ওই ব্যক্তি সম্পর্কে তার কোনও সংশয় তৈরি হয় না। ফলে প্রতারকরা কৌশলে প্রতারণা করতে পারে। অপরাধীরা তাদের টার্গেট করা ব্যক্তিকে মৃত্যুর হুমকি দেওয়াসহ আরও অনেক কিছুই করে থাকে। এতে বিপদে পড়েন নম্বরটির যিনি প্রকৃত মালিক তিনি। তার পরামর্শ হলো, সিম হালনাগাদ করে নিলে এ ধরনের সমস্যা হবে না।
সিম ক্লোন হওয়ার বিষয়টি কীভাবে বোঝা যাবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যদি কোনও কারণ ছাড়াই কারও মোবাইল নম্বরের ব্যালান্স কমে যায় তাহলে সিমটি ক্লোন হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। এক্ষেত্রে ফোন নম্বরটি সুইসড অফ বা বন্ধ করে অন্য নম্বর থেকে নিজের নম্বরে ফোন দিয়ে দেখতে হবে। যদি রিং বাজতে থাকে তাহলে বোঝা যাবে সিমটি ক্লোন করা হয়েছে। এছাড়াও মোবাইল সেটের মধ্যে নতুন কোনও সফটওয়্যার বা অ্যাপসের উপস্থিতি দেখলে বা কোনও ছোট ডিভাইস পেলে সতর্ক হতে হবে। এগুলো দিয়েও সিম ক্লোন করা হতে পারে।

 

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *