Main Menu

শিশু সাহিত্যে কবিগুরু, বাঙালির ছোটবেলা জুড়ে রয়েছে রবি ঠাকুর

রবীন্দ্রনাথ ছাড়া কোনও বাঙালি কি পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে গড়ে উঠতে পারে? অন্তত নিম্ন-মধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানের বড় হওয়ার ক্ষেত্রে তো রবীন্দ্রনাথের পরশ থাকবেই। নিম্নবিত্ত বা উচ্চবিত্ত শ্রেণীর শিশুদের কথা এখানে বাদ রাখতেই হচ্ছে তার কারণ তাদের ক্ষেত্রে আর্থসামাজিক কারণেই পারিবারিক মূল্যবোধের মাত্রাগুলো সম্পূর্ণ অন্যরকম। ব্যতিক্রম যে নেই তা একেবারেই নয়।

একটা সময় ছিল যখন “গান জানো না, তবলা জানো না তাহলে আবৃত্তি তো জানোই । একটা আবৃত্তি শুনিয়ে দাও”। এভাবেই পারিবারিক সমাবেশে বাঙালি শিশুর সংস্কৃতি চর্চা চলত। এবং মূলত এই চর্চার মূল উৎসাহদাতা হতেন শিশুদের মায়েরা। সহজ পাঠ বা কিশলয়ে প্রকাশিত কবিতাগুলো বাদ দিয়েও শিশু ভোলানাথ বা সঞ্চয়িতার দু একটা শক্ত কবিতা বাঙালি বালক- বালিকা, কিশোর-কিশোরীরা মোটামুটি রপ্ত করে নিতেন। নিয়ম করে কোন বড় রবীন্দ্র গানের শিল্পীর কাছে যারা গান শিখতেন তাদের কথা আলাদা। তা বাদ দিয়ে মোটামুটি সমস্ত রকম উৎসব অনুষ্ঠানে কিশোর কুমার আশা ভোঁসলের রবীন্দ্র সংগীত প্রায় ৯০ এর দশক পর্যন্ত উৎসব প্রাঙ্গণ মুখরিত হয়ে উঠতো। রবীন্দ্র গানের সঙ্গে বেশিরভাগ বাঙালি শিশুর পরিচয় কিন্তু সম্ভবত কিশোর কুমারের আর আশা ভোঁসলের রবীন্দ্র সংগীতের মধ্যে দিয়েই। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় অরুন্ধতী হোম চৌধুরী এরাও বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। আর শহর এবং শহরতলীতে অপেক্ষাকৃত বেশি রবীন্দ্র অনুরাগী কোন দাদা বা দিদির উদ্যোগে পাড়ার ২৫ শে বৈশাখ। এই ছিল সাধারণ বাঙালির মোটামুটি রবীন্দ্রচর্চা। আজকের শহরের মধ্যবিত্তের ছেলেমেয়েরা প্রথম থেকেই ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করে সে ক্ষেত্রে বাংলা শিক্ষাটা তাদের কাছে অপশনাল। দ্বিতীয় বা তৃতীয় ভাষা। তবুও কিছু কিছু বাবা মা নিঃসন্দেহে পড়াশোনার শুরুর দিনটাতে কোথাও না কোথা থেকে একটা সহজপাঠ জোগাড় করে নেয় অনেক শিশুকেই বাংলার সঙ্গে পরিচিত করেন। সহজপাঠ ই মে বাঙালির রবীন্দ্র সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয়ের প্রথম সূত্রপাত।

প্রাথমিকভাবে অক্ষরজ্ঞান পরে ছন্দ যুক্তাক্ষর এই সমস্ত সঙ্গেই পরিচয় সহজপাঠের অমূল্য ছড়া আর নন্দলাল বসুর wood stencil এর ছবির মাধ্যমে।

স্বয়নে স্বপনে জীবনচর্যায় সমস্ত ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের মত আদর্শ সংস্কৃতিকেই বাঙালি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরবে- এ এক অলীক কুসুম কল্পনা। বাঙালি জাতি সেই ধাতে গড়া না। তার জাতিসত্তায় এসো শ্যামলও সুন্দরও এবং লুঙ্গি ডান্সের সমান আধিপত্য। কিছু ক্ষেত্রে তাই রবীন্দ্র সৃষ্টি উলু বনে মুক্তো ছড়ানোর মতো ঘটনায় পর্যবসিত হয়েছে। তবু রবীন্দ্রনাথের দিক থেকে দেখলে- ছোটদের জন্য রবির লেখা অনবদ্য। তিনি তাদের জন্য অনেক লিখেছেন। সারাজীবনই শিশুদের কথা মাথায় রেখে লিখে গেছেন কবিগুরু। আদর্শ মানুষ তৈরির জন্য শান্তিনিকেতন তৈরি করেছেন। ছোটদের জন্য শুধু ছড়া, কবিতা, গল্প লেখেননি, বরং স্কুলে পড়ার জন্য লিখেছেন সহজপাঠ, লিখেছেন ইংরেজি শেখার জন্য ইংরেজি সোপান।

বিশাল এক উচ্চবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করার কারণেই ছোটবেলায় ঠাকুর পরিবারের সমস্ত শিশুর মত রবির জীবন ছিল অকিঞ্চিৎকর। অগুরুত্বপূর্ণ। মূলত ভৃত্যদের শাসন এবং অনুশাসনের বেড়াজালে ঘেরা। জোড়াসাঁকোর শিশু শিশুদের জন্য বরাদ্দ ঘরের জানলাই ছিল একমাত্র মুক্তির অবকাশ। মনে মনে মুক্ত জীবনের ছবি আঁকতেন। স্বপ্নময় জীবনের কথা লিখতে থাকেন কবিতায়, গল্পে, ছড়ায় তথা শিশুসাহিত্যে। বিশ্বকবির হাতে শিশুসাহিত্য সূচনা হয় আশ্চর্য মায়াময় এক অনুভূতি নিয়ে। ছোটদের জন্য তিনি একের পর এক কবিতা লেখেন। ১৯০৯ সালে প্রকাশিত হয় তার শিশুতোষ কবিতার বই, “শিশু”। ‘শিশু’ কাব্যগ্রন্থটি শিশু সাহিত্যের আকরগ্রন্থ রূপে পরিচিত। শিশু ১৯০৩-০৪ সালে কাব্যগ্রন্থের ৭ম ভাগে প্রথম প্রকাশিত।

১৯০৯ সালে স্বতন্ত্র গ্রন্থাকারে প্রকাশ। ‘শিশু’ প্রকাশ হওয়ার এক বছর আগে রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী মৃণালিণী দেবীর মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুর পর নিজের মাতৃহীন শিশুদের করুণ অবস্থার কথা অনুভব করেন কবি। “শিশু” কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলোর অধিকাংশই শিশুর জবানীতে মাকে উদ্দেশ্য করে রচিত। ‘শিশু’ কাব্যের ৬১টি কবিতার মধ্যে জন্মকথা – “বিদায়” ৩১টি কবিতা রূগ্নপত্নীর শয্যায় আপন শিশুপুত্র শমীন্দ্রের কথা মনে রেখেই রচনা করেন।

কবির অন্তরে শিশুকে কেন্দ্র করে যখন যে ভাবোদয় হয়েছে কবিতাগুলো সেটারই প্রকাশ। এই কবিতাগুলো রচনার উদ্দেশ্য ছিল, এগুলির সাহায্যে শিশুদের কল্পনাকে আলোকিত করা। মৃনালিণী দেবী মারা যাওয়ার পর রবি মাতৃহীন শিশুদের করুণ অবস্থার কথা অনুভব করেন। ১৯০৩ সালে ‘শিশু’ প্রকাশকালে কন্যা রেনুকার মৃত্যু হয়। চার বছরের পুত্র শমীন্দ্রনাথ মারা যান।

‘শিশু ভোলানাথ’ কাব্যগ্রন্থটি ‘শিশু’ কাব্যগ্রন্থের মতো মায়ের সঙ্গে শিশুর খেলা, মায়ের কাছে মনের কথা বলা, ইচ্ছা ও শৌর্যের প্রকাশ। ‘শিশু ভোলানাথ’ এর কবিতাগুলো ছড়া জাতীয় নয়। ছন্দবৈচিত্র্যে অপরূপ ধ্বণি ও ভাবরসে সমৃদ্ধ। খাপছাড়া গ্রন্থের ছড়াগুলোর রচনাকাল ১৯৩৫-৩৬ খ্রিস্টাব্দে। এতে কবি লেখনির সাহায্যে অতুলনীয় যাদুর খেল দেখিয়েছেন। মনে যখন যে কথা উঁকি দিয়েছে কবিগুরু তাকে ছন্দবদ্ধ করে প্রকাশ করেছেন। তাঁর হাতে শিশুসাহিত্য একটি বিশিষ্টতা লাভ করেছে।

তিনি নিজে লিখেছেনও যেমন, তেমনি লোকসাহিত্যের যে অংশ শিশুসাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে, সেই ছেলে ভুলানো ছড়া (১৯০৭) সংগ্রহ ও প্রকাশের মহান দায়িত্বও সুষ্ঠুভাবে পালন করেন। রবীন্দ্রনাথের ছিল নির্মল হাসির জগৎ, তিনি হাসতেন ও হাসাতেন। হাসতে হাসতে অনেক কিছু শেখাতেনও। তিনি কিছু ছোট ছোট হাসির নাটিকা লিখেছেন, যেগুলো হাস্যরসে ভরপুর।

রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলা সম্পর্কে কার না কৌতুহল আছে। তার ছেলেবেলার সজীব স্মৃতি বই “ছেলেবেলা”। তাকে জানতে ছেলেবেলা পড়া খুবই জরুরি। আমরা রবীন্দ্র শিশুতোষকে পাঠকের দৃষ্টিগোচর করতে পারি নিম্নরূপ ভাবে-আমাদের শিশুশ্রেণিতে পাঠ্যবইয়ে প্রথমে যে ছড়াটি সংকলিত হয়েছে তা হল “আগডুম-বাগডুম”। অনেকেরই জানা না থাকলেও আসলে এটি রবীন্দ্রনাথের ‘ছড়া সংগ্রহের’ ৩৯নং ছড়া

“আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে

ঢাক মৃদং ঝাঁঝর বাজে।।”

শিশুতোষ কবিতার বই শিশু কাব্যগ্রন্থে ‘প্রশ্ন’ শিরোনামের কবিতায় কোমল শিশুর মনে বেশি পড়ার প্রতি অনীহা এবং বাবা-মার অতি শাসন সত্ত্বেও না পড়ার আবদার প্রস্ফুটিত হয়েছে। খেলার প্রতি অতি আকর্ষণের চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। একই কাব্যগ্রন্থের বীরপুরুষ শিরোনামের কবিতায় মায়ের সঙ্গে শিশুর সহযাত্রা বীরদর্প প্রকাশ পেয়েছে। শিশুমনের বীরত্বগাঁথা আকাঙ্খা প্রস্ফুটিত হয়েছে। “বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর” এই ছড়ার মধ্যে বর্ষাকালে মেঘলা দিনের চিত্র ফুটে উঠেছে। শিশু ভোলানাথ কাব্যগ্রন্থে ‘তালগাছ’ শিরোনামে কবিতাটি শিশুদের মুখে মুখে শোনা যায়। এ দিয়ে শিশুমনকে ভোলানোও যায়।

শিশুদের নিয়ে রবীন্দ্রনাথ শুধু কবিতা, ছড়া লিখেননি, তিনি হাস্য-রসাত্মক ও কৌতুকরসনির্ভর নাটিকাও লিখে গেছেন। তাঁর প্রত্যেকটি ছোট গল্প কাচেঁর ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখার মতো। দেনা-পাওনা, ছুটি, হৈমন্তি, সমাপ্তি, অপরাজিতা- এগুলো যুগে যুগে আবহমান বাঙালিকে যে সাহিত্যরস জুগিয়েছে তা অতুলনীয়।

কবিগুরু শিশুসুলভ মন দিয়ে শিশুদের জন্য সাহিত্যসম্ভার রচনা করেন। এর প্রভাব ভারতীয় উপমহাদেশ তথা বিশ্ব শিশু সাহিত্যে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। আজ প্রযুক্তিনির্ভর শিশুমনকে আনন্দ দেয়ার জন্য রাবিন্দ্রিক শিশুভাবনাকে নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করার সময় এসেছে। আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। এই কথাটি পূর্ণাঙ্গতা পাবে তখনই যখন বাংলা সাহিত্যের অত্যুজ্জ্বল নক্ষত্র রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর সৃষ্টিকে শিশুরা আগ্রহভরে জানবে। বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করবে।

Leave a comment






এই বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

shuddhobarta24
Privacy Overview

This website uses cookies so that we can provide you with the best user experience possible. Cookie information is stored in your browser and performs functions such as recognising you when you return to our website and helping our team to understand which sections of the website you find most interesting and useful.