Main Menu

স্বাস্থ্যসেবা যেভাবে ইবাদতে পরিণত হয়

ড. আবুু সালেহ মুহাম্মদ তোহা : শরীরকে রোগমুক্ত করে সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার প্রচেষ্টাই হলো স্বাস্থ্যসেবা। মহান আল্লাহই মানুষের জীবন ও মৃত্যুর মালিক। কেউ যেমন জীবন দিতে পারে না, তেমন মৃত্যুও স্থগিত করতে পারে না। তবে স্বাস্থ্যসেবা নির্ধারিত মৃত্যুর সময় আসা পর্যন্ত জীবনকে সুস্থ, স্বাভাবিক, সুন্দর ও সচল রাখতে সাহায্য করে। মানুষের চলাফেরা, জীবন-জীবিকা, ইবাদত বন্দেগিসহ সব কিছুই নির্ভর করে শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার ওপর। শারীরিক সুস্থতা ছাড়া নামাজ, রোজা ও হজের মতো মৌলিক ইবাদত পালন করা সম্ভব নয়।

যাঁরা স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত আছেন, তাঁরা অতি মহৎ কাজ আঞ্জাম দিচ্ছেন। ডাক্তার, নার্স, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, ঔষধ প্রশাসন, উৎপাদন ও ক্রয়-বিক্রয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে জড়িয়ে আছেন। আর সব শ্রেণি-পেশার মানুষ প্রতিনিয়ত স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করছে। স্বাস্থ্যসেবার এই বৃহত্তর পরিসরে ইসলামী মূল্যবোধ জাগ্রত করতে পারলে স্বাস্থ্যসেবায় মানুষের আস্থা, বিশ্বাস ও গ্রহণযোগ্যতা আরো সুদৃঢ় হবে এবং মানুষ তাদের প্রশান্তির জায়গা খুঁজে পাবে। সেই সঙ্গে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান অনন্য ইবাদত হিসেবে পরিগণিত হবে।

এক. দায়িত্বসচেতন হওয়া : সব পেশাতেই নির্দিষ্ট দায়িত্ব-কর্তব্য পালনের বিনিময়ে বেতন-ভাতা বা পারিশ্রমিক পাওয়া যায়। পেশাদারির সঙ্গে দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করতে পারলেই বেতন-ভাতা বা পারিশ্রমিক বৈধ হয়। এর মধ্যে যদি সেবা আদান-প্রদানের এবং মানুষের জীবন-মরণ সম্পর্কিত পেশা হয়, তাহলে পেশাদারি, দায়িত্ব ও কর্তব্য আরো বেড়ে যায়। আরো সতর্কতার সঙ্গে কাজ করার অপরিহার্যতা সৃষ্টি হয়। এ জন্যই একজন স্বাস্থ্যকর্মীকে যোগ্য, দক্ষ, সহানুভূতিশীল, দায়িত্ববোধসম্পন্ন হতে হয়। মহানবী (সা.)-এর যুগে একনিষ্ঠ একজন নার্স ছিলেন রুফাইদা (রা.)। তিনি যুদ্ধের ময়দানে নার্সের দায়িত্ব পালন করতেন। খন্দক যুদ্ধে আহত সাদ (রা.)-কে রুফাইদা (রা.)-এর সেবা প্রদানের বিষয়টি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। (আস-সিলসিলাতুস সহিহাহ, হাদিস : ১১৫৮)

রুফাইদা (রা.) ছিলেন একজন আদর্শ স্বাস্থ্যকর্মী। সহানুভূতি, দায়িত্ববোধ ও ক্লিনিক্যাল যোগ্যতা ও দক্ষতার অপূর্ব সমন্বয় ছিল তাঁর মধ্যে। তৎকালীন মদিনার অসুস্থদের সেবা করতেন তিনি। উম্মে আতিয়া (রা.) বলেন, ‘আমরা যুদ্ধের ময়দানে অসুস্থদের খোঁজখবর নিতাম আর আহতদের চিকিৎসাসেবা প্রদান করতাম।’ (বুখারি, হাদিস : ৯৩৭)

দুই. কল্যাণকামী হওয়া : ‘দ্বিন মানেই হলো নসিহত বা কল্যাণকামিতা।’ (মুসলিম, হাদিস : ২০৫) আর সব মানুষের প্রতি কল্যাকামিতা হলো, সঠিক পথ ও কল্যাণকর কাজের দিকনির্দেশনা দেওয়া, ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া, দোষ-ক্রটি গোপন রাখা, প্রয়োজন পূরণ করা, প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতা না করা, হিংসা পোষণ না করা। সবার প্রতি সহনশীলতা প্রদর্শন এবং সব কাজে সেবার মানসিকতা জাগ্রত করা। স্বাস্থ্যসেবায় কল্যাণকামিতার এ বিষয়গুলো বাস্তবায়িত হলে স্বাস্থ্যসেবাও দ্বিনি কাজ হিসেবে পরিগণিত হবে।

তিন. অন্যের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করা : রোগব্যাধি মানুষের হাসি-আনন্দ ম্লান করে দেয়। রোগীসহ পুরো পরিবার মানসিক কষ্টে পড়ে যায়। এক ডাক্তার থেকে অন্য ডাক্তার, এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতাল দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়। এর সঙ্গে আর্থিক সংকট থাকলে তাদের আরো ভেঙে পড়তে দেখা যায়। ডাক্তার, নার্স ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা এ ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি নবী (সা.)-এর কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয় মানুষ কে? আর আল্লাহর কাছে বেশি পছন্দের আমল কোনটি? রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয় সে, যে অধিক পরোপকারী। আর আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয় আমল হলো, কোনো মুসলমানের মনে খুশি প্রবেশ করানো, তার কোনো বিপদ দূর করা, তার কোনো ঋণ পরিশোধ করা অথবা তার ক্ষুধা দূর করা। অন্য ভাইয়ের প্রয়োজনে হেঁটে যাওয়া আমার কাছে এই মসজিদে (নববী) এক মাস ইতিকাফ করার চেয়ে উত্তম। (তাবারানি, হাদিস : ৮৬১)

চার. লোভ পরিহার করা : লোভ মানব চরিত্রের দুর্বল ও হীন বৈশিষ্ট্যের একটি। এর সাহায্যেই সৃষ্টি হয় অসৎ ও অবৈধ কাজের বিভিন্ন পন্থা। মানবিক গুণাবলি ভূলুণ্ঠিত হয়ে অর্থ-সম্পদ উপার্জনই হয়ে উঠে জীবনের পেশা আর নেশা। ফলে সেবা প্রদান পরিণত হয় রক্ত চুষে নেওয়ার আখড়া। লোভীদের ব্যাপারে রাসুল (সা.) বলেন, যদি কোনো মানুষের এক উপত্যকা ভরা সোনা থাকে, তাহলে সে তার জন্য দুই উপত্যকা ভরা সোনা হওয়ার আশা করে। তার মুখ মাটি ছাড়া (মৃত্যু পর্যন্ত) আর কিছুতেই ভরে না। (বুখারি, হাদিস : ৬০৭৫)

মহান আল্লাহ বলেন, ‘প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা তোমাদের মোহাচ্ছন্ন রাখে। যতক্ষণ না তোমরা কবরে উপনীত হও। এটা সংগত নয়, তোমরা শিগগির তা জানতে পারবে।’ (সুরা তাকাসুর, আয়াত : ১-৩)

পাঁচ. প্রতারণার আশ্রয় না নেওয়া : পৃথিবীতে সবাই একে অন্যের সহযোগিতা নিয়ে বেঁচে থাকে। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রত্যেকেই প্রত্যেকের সহযোগী। সহযোগিতার আশায় মানুষ সেবা প্রদানকারীর দারস্থ হয়। সেবা প্রদানকারী ধোঁকা ও প্রতারণার আশ্রয় নিলে গ্রহীতা হয়তো বুঝতেই পারে না বা বুঝলেও অনেক সময় কিছু করার থাকে না। অপ্রয়োজনীয় চিকিৎসা, অননুমোদিত ওষুধ প্রেসক্রাইব, ওষুধ না দিয়ে বিল, অতিরিক্ত বিল, মিথ্যা সার্টিফিকেট প্রদান, পরীক্ষা না করে রিপোর্ট প্রদান, চিকিৎসার সুযোগে যৌন অসদাচরণ, অপ্রয়োজনে রোগীকে আইসোলেশনে রাখাসহ বিভিন্নভাবে সেবাগ্রহীতা প্রতারণার শিকার হয়ে থাকে। এসব প্রতারণায় পরকালে তো বটেই, অনেক সময় দুনিয়াতেই শাস্তি পেতে হয়। এগুলো কোনো মুসলমানের কাজ হতে পারে না। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে আমাদের ধোঁকা দেয় সে আমাদের দলভুক্ত নয়।’ (মুসলিম, হাদিস : ২৯৪)

পরিশেষে বলা যায়, স্বাস্থ্যসেবায় উল্লিখিত ধর্মীয় মূল্যবোধ বাস্তবায়িত হলে স্বাস্থ্যসেবা কল্যাণ আর সমৃদ্ধিতে ভরে উঠবে।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক

আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

Leave a comment






এই বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

shuddhobarta24
Privacy Overview

This website uses cookies so that we can provide you with the best user experience possible. Cookie information is stored in your browser and performs functions such as recognising you when you return to our website and helping our team to understand which sections of the website you find most interesting and useful.