Home » এন্ড্রু কিশোর : পারিবারিক স্মৃতি থেকে

এন্ড্রু কিশোর : পারিবারিক স্মৃতি থেকে

৬ জুলাই (২০২০) আমার প্রিয় কিশোর দাদা প্রয়াত হলেন। আগের মাসে ১১ জুন সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফেরার পর দিদির কাছে আমি পত্রিকায় প্রকাশিত একটি লিঙ্ক পাঠিয়েছিলাম। যেখানে লেখা ছিল ‘সুস্থ হয়ে দেশে ফিরলেন এন্ড্রু কিশোর’। সেটা আমার কাছে খুব খুশির খবর ছিল। তার কিছু দিন পর পারিবারিক সূত্রে সিসিডিবির সাবেক নির্বাহী পরিচালক জয়ন্ত অধিকারী দাদা জানালেন তাঁর অবস্থা অবনতির দিকে। আমি দিদির কাছে জানতে চাওয়ার পর তিনি ২ জুলাই জানিয়েছিলেন খারাপের দিকে- ‘ভেরি ফিউ মান্থস’ টিকে থাকতে পারেন। কিন্তু ৫ জুলাই ‘এন্ড্রু কিশোর’-এর ফেসবুক পেজে দিদির স্ট্যাটাসটি পড়ে মন ভেঙে যায়, আতঙ্ক ভর করে মাথায়। সেখানে তিনি লিখেছেন- ‘এটাই শেষ পোস্ট, এরপর আর কিছু বলা বা লেখার মতো আমার মানসিক অবস্থা থাকবে না। এখনও মাঝে মাঝে দুঃস্বপ্নের মতো মনে হয়, কিশোর থাকবে না অথচ আমি থাকবো, মেনে নিতে পারছি না।’

ওই স্ট্যাটাসে তিনি আরও লিখেছেন, কিশোর দা দেশে মরতে চেয়েছিলেন। ফিরেছিলেন জন্মস্থানে, মেনে নিয়েছিলেন অবধারিত মৃত্যুকে। আশ্চর্য লাগে এই ভেবে যে, মারণব্যাধির কি নিষ্ঠুর বাস্তবতা- মানুষকে তার করালগ্রাসের মধ্যে বসে জীবনের গান গাইতে হয়। করোনা মহামারির দুর্যোগ না থাকলে হয়তো এন্ড্রু কিশোরের মরদেহ শহীদ মিনারে আনা হতো। আমরা প্রিয় শিল্পীর মুখটি শেষবারের মতো দেখে শ্রদ্ধা জানিয়ে আসতে পারতাম। কিন্তু এও এক বিপর্যয়। পৃথিবীব্যাপী মানুষের বেঁচে থাকার লড়াই ব্যক্তি থেকে পরিবার, পরিবার থেকে সমাজ ও রাষ্ট্রে ব্যাপ্ত হয়েছে। তবু শেষ পর্যন্ত অকালমৃত্যুর কারণে ব্যক্তির সংসার-পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনের দুঃখ সীমাহীন। কিন্তু আমরা আশাবাদী ছিলাম।

সকলে জানেন শরীরে নানা ধরনের জটিলতা নিয়ে অসুস্থ অবস্থায় ২০১৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২০ এর ১০ জুন পর্যন্ত রোগমুক্তির জন্য সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন ছিলেন এন্ড্রু কিশোর। ১৮ সেপ্টেম্বর ব্লাড ক্যানসার ধরা পড়ার পর আমরা ভেবেছিলাম এর আগে ২০০৭ সালে কণ্ঠশিল্পী সাবিনা ইয়াসমীন সেখান থেকে ক্যানসারের চিকিৎসা করিয়ে ভালো হয়ে গেছেন। অতএব কিশোরদাও নিশ্চিত ভালো হবেন। কিন্তু দেশের গণ্ডী ছেড়ে সারা বিশ্বের সম্পদ হয়ে ওঠা খ্যাতিমান এন্ড্রু কিশোর চতুরব্যাধির কাছে হেরে গেলেন। এই কঠিন সত্য মেনে নিয়ে এক শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘এন্ড্রু কিশোর তাঁর গানের মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।’ আমরা সকলে জানি তাঁর চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করেছেন সরকার প্রধান, মানবতার দিশারি শেখ হাসিনা। পরিবারের পক্ষ থেকে আমরা সকলে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ।

২.

এন্ড্রু কিশোরের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় তাঁর মগবাজারের বাসায়। ১৯৮৯ সালে আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র। তাঁর সহধর্মিনী লিপিকা খান, যাকে আমরা ছোটবেলা থেকে ইতি’দি ডাকছি তিনি আমার ফুপাত বোন। আমার বাবারা ছিলেন চার বোন, দুই ভাই। সেই চার বোনের সেজোজনের মেয়ে ইঞ্জিনিয়ার লিপিকা খান। ইতি’দিরাও চার বোন দুই ভাই। দিদির সূত্রে নিকট আত্মীয় হলেও তখন কিশোর দা দেশের খ্যাতিমান কণ্ঠশিল্পী। এ জন্য সম্মান, সমীহ ও সতর্কতার সঙ্গে তাঁর সঙ্গে কথা বলা শুরু করি। যেহেতু দিদি আমাকে ‘তুই’ সম্বোধন করেন এ জন্য প্রথম থেকে তিনিও আমাকে সেভাবেই ডেকে এসেছেন। বাসায় আসা-যাওয়ার সূত্রে তিনি আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে থাকার ব্যাপারে তাঁর বন্ধু তৎকালীন ছাত্রলীগের সভাপতি হাবিবুর রহমান হাবিবের (পরে বিএনপিতে যোগ দেন) সঙ্গে কথা বলতে বলেছিলেন। আমি মধুর ক্যান্টিনে নেতার সঙ্গে দেখা করে কিশোর দার কথা বললে সঙ্গে সঙ্গে তিনি জগন্নাথ হলের নেতা বিমল দাকে ডেকে আমাকে সিটের ব্যবস্থা করতে বলেছিলেন। কিশোর দার রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে যোগাযোগ ও পরিচিত জগতের সন্ধান তখনই পেয়েছিলাম। অবশ্য শেষ পর্যন্ত ছাত্রলীগের ব্যবস্থাপনায় জগন্নাথ হলের সিটে থাকাটা আমার জন্য সুবিধার হয়ে ওঠেনি। কারণ ওই হলে তখন হরহামেশা ছাত্রলীগ-জাসদের আধিপত্যের লড়াই ছিল। বন্দুকযুদ্ধের মধ্যে পড়ার সমূহসম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। এছাড়া ছাত্রলীগের আঞ্চলিক গ্রুপিং ছিল মারাত্মক। একদিকে স্বৈরশাসক এরশাদবিরোধী আন্দোলনের ঢেউ অন্যদিকে একটি গ্রুপের সঙ্গে অন্য গ্রুপের গোলাগুলির ভয়ঙ্কর ঘটনা আমার ‘হল’ জীবনের একটি অভিজ্ঞতা বটে।

এন্ড্রু কিশোরের সঙ্গে ছিল আমার দীর্ঘ ৩০ বছরের যোগাযোগ। তাঁর সৌজন্যেই ঢাকা শহরে আমি চাইনিজ রেস্টুরেন্টে খাবারের প্রথম অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করি। সেই ডিনারের সূত্রে সে সময় দেশের সাংস্কৃতিক জগতের বিখ্যাত কিছু ব্যক্তির সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। কণ্ঠশিল্পী থেকে শুরু করে গীতিকার-সুরকারদের সঙ্গে কিশোরদার আন্তরিক সম্পর্কের সেই নজির দু’সন্তান সপ্তক ও সংজ্ঞার ক্ষেত্রেও স্নেহ-মমতায় পল্লবিত হতে দেখেছি। এন্ড্রু কিশোর বাংলা চলচ্চিত্রের সর্বাধিক গান গাওয়া শিল্পী। চলচ্চিত্রে তাঁর চেয়ে বেশি জনপ্রিয় গান আর কারও নেই। ১৯৭৭ সালে আলম খানের সুরে ‘মেইল ট্রেন’ চলচ্চিত্রে ‘অচিনপুরের রাজকুমারী নেই যে তার কেউ’ গানের মধ্য দিয়ে তাঁর চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক যাত্রা শুরু হয়। তারপর ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’ গানের মধ্য দিয়ে জনগণের হৃদয়ে পৌঁছে যান। তাঁকে ‘প্লে-ব্যাক’ সম্রাট বলা হয়।

তবে তিনি বাংলাদেশের সঙ্গীত জগতে খুব সহজেই নিজের জায়গাটি তৈরি করে নিয়েছিলেন এরকমটি নয়। রাজশাহী থেকে ঢাকায় এসে তাঁকে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। প্রতিদ্বন্দ্বীরা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে ‘আন্ডা’ কিশোর অভিধা দিয়েছিল। কিন্তু মধ্যবিত্তের এই সন্তান দমে যাবার পাত্র ছিলেন না। আমার দুই মামার বসতি থাকায় রাজশাহী শহরের খ্রিস্টান পরিবারগুলোর সঙ্গে আগে থাকতেই একটি সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। মামার বাড়ি যাওয়া-আসার সূত্রে কিশোর দার পরিবার সম্পর্কে আগে থেকেই আমরা জানতাম। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় তাঁর বাবা ক্ষিতিশ চন্দ্র বাড়ৈ ও মা মিনু বাড়ৈ আদি নিবাস গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া থেকে রাজশাহীতে এসে দুজনেই খ্রিস্টান মিশন হাসপাতালে চাকরি নেন। ১৯৫৫ সালের ৪ নভেম্বর এন্ড্রু কিশোরের জন্ম রাজশাহীতে। স্বাধীনতার পর প্রথমে বাবা ও পরে তাঁর মা মারা যান। বড় বোন ডাক্তার শিখা বিশ্বাসের আদর স্নেহ ভালোবাসায় বড় হন এই শিল্পী।

রাজশাহীতে বোনের বাসাটি ছিল কিশোরদার প্রিয়প্রাঙ্গণ। রাজশাহীর সঙ্গে তাঁর ছিল প্রাণের যোগাযোগ। তিনি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো শিক্ষা জীবনটাই রাজশাহীতে শেষ করেন। তাঁর সঙ্গীত জীবনের সূচনাও সেখান থেকে। ওস্তাদ আব্দুল আজিজ বাচ্চুর কাছ থেকে তালিম নিয়ে তিনি সমৃদ্ধ হন। এ জন্য ওস্তাদের স্মৃতি রক্ষার্থে একটি স্মৃতি সংসদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি ছিল তাঁর আলাদা টান। বিশেষত বিভিন্ন সময়ে সমাবর্তনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তিনি একাধিকবার অংশগ্রহণ করে দর্শক মাতিয়েছিলেন। তাঁর বাসায় বসে ব্যক্তিগত আলাপের সময় আমি মাঝে মাঝে বলতাম, ‘দাদা, আপনি আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খ্রিস্টান ছাত্র সংগঠনের অনুষ্ঠানে গান গাইতে গেলে আমরা নিজেকে ধন্য মনে করতাম।’ তিনি কাটকাট জবাব দিতেন, ‘কত টাকা দিবি।’ বুঝতাম তিনি পেশাদার কণ্ঠশিল্পী। নব্বই দশকে বসে তাঁর সঙ্গে যখন কথা বলছি, তার আগে থেকে অর্থাৎ আশির দশক থেকে তাঁর গানের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। তখন থেকে তিনি দুই বাংলায় গান করেছেন। একের পর এক জনপ্রিয় গান উপহার দিচ্ছেন। ১৯৮২ সাল থেকে ক্রমান্বয়ে বাংলা চলচ্চিত্রের গানে অবদান রাখার জন্য তিনি আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন।

৩.

কেবল আত্মীয়তার খাতিরে বলছি না কিশোর’দাকে যারা জানেন তাঁরা নিশ্চিতে বলবেন তিনি ছিলেন অসম্ভব সরল সহজ মনের মানুষ ও বন্ধুবৎসল। সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক আলম খানকে তাঁর বাড়িতে দেখেছি, শুভ্রদেবের সঙ্গে তাঁর আন্তরিকতা সবসময়ই চোখে পড়ত। মিরপুর দশের বাসাতে তিনতলায় তাদের একত্রে তাস খেলতে, ক্রিকেট ম্যাচ উপভোগ করতে দেখা যেত। আমার আরেক ফুপাত বোন ছন্দাদির বাসা ছিল ক্রিকেট খেলা নিয়ে মেতে থাকার আঙিনা। সেখানেই মুকুলদার সৌজন্যে আড্ডা দিতেন শুভ্রদেব। এক্ষেত্রে ইতি’দির ভূমিকা ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি সংসার সামলে, নিজের অসুস্থ পিতার (আমার ফুপা) খোঁজ রেখে তারপর শিল্পীদের বাসায় আপ্যায়ন করতেন। কিশোর’দার বিদেশে কোনো গানের অনুষ্ঠান থাকলে কখনো কখনো সঙ্গী হতে হয়েছে দিদিকেও। ৫ জুলাই (২০২০) কানাডা প্রবাসী জনপ্রিয় শিশুসাহিত্যিক লুৎফর রহমান রিটন এ রকম একটি অনুষ্ঠানের ঘটনা বর্ণনা করে ফেসবুকে লিখেছেন- ‘এক মধ্য রাতে মন্ট্রিয়লের বিখ্যাত ক্যাসিনো অভিযানে বেরুলাম আমরা। সেখানেও ভাবি আছেন এন্ড্রুর সঙ্গে বিশ্বস্ত সহচরী। এন্ড্রুও দেখলাম খুবই নির্ভরশীল ভাবির ওপর। ভাবিকে ছাড়া চলতে পারে না এককদমও।’ সিঙ্গাপুরে স্বামীর চিকিৎসার সময় দিদির সেই সহমর্মী ও আত্মত্যাগের বৈশিষ্ট্যটি খুঁজে পেয়েছে দেশবাসী। স্ত্রীর প্রতি কিশোর’দার যেমন নির্ভরশীলতা ছিল তেমনি সন্তানদের লেখাপড়ার বিষয়ে ছিলেন অত্যন্ত সতর্ক। ছেলে-মেয়েকে ভালো প্রতিষ্ঠানে পড়িয়ে যোগ্য করে তুলে রেখে গেছেন; এককথায় গানের ভুবনে ব্যস্ত থাকলেও দায়িত্বশীল পিতার ভূমিকা পালন করেছেন তিনি।

আরও দেখেছি পারিবারিকসূত্রে আত্মীয়-স্বজনের প্রতি এন্ড্রু কিশোরের যত্ন ও দায়িত্ব পালনের নিষ্ঠা। তিনি আমার ফুপা পল খানকে তাঁর বাসায় কেবল শ্বশুর হিসেবে জায়গা দিয়েছিলেন এমন নয় বরং তাঁর অসুস্থতার মুহূর্তে চিকিৎসা করিয়ে, হাসপাতালে উপস্থিত হয়ে দিনের পর দিন সময় দিয়েছেন। আমার ফুপার মৃত্যু ঘটে কিশোর দার বাড়িতেই। আবার ফুফু অসুস্থ হলে তিনি একইভাবে তৎপর হয়েছেন। তিনি নিজের বোন শিখা বিশ্বাসের ছেলে-মেয়েদের বিষয়েও যত্নশীল ছিলেন। তাঁর গৃহে অবস্থান করেই এই বোনের ছেলে লেখাপড়া শেষ করে।

কণ্ঠশিল্পী হিসেবে খ্যাতিমান হয়েছিলেন ঠিকই; তাই বলে তিনি কখনো কোটিপতি ছিলেন না। যতদূর মনে পড়ে একদিন বলেছিলেন তাঁর সিনিয়র সাবিনা ইয়াসমীন, রুনা লায়লা একটি গানের জন্য ৩/৪ হাজার টাকা পান। সেখানে তাঁর ইনকাম রাশি রাশি মনে করার কোনো কারণ নেই। এ জন্যই ১৯৮৭ সালে জলি ডহুর ও অন্যান্যদের সঙ্গে মিলে ‘প্রবাহ’ নামে বিজ্ঞাপন প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছিলেন। আর্থিক সঙ্গতি বৃদ্ধির জন্যই আমার বোনকে বুয়েট থেকে আরেকটি ডিগ্রি নিয়ে প্রকৌশলী হিসেবে চাকরিতে যোগ দিতে হয়েছিল। তবু আমাদের খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের প্রত্যাশা ছিল বেশি। এলাকার খ্রিস্টানরা যেকোনো অনুষ্ঠানে তাঁর কাছে চাঁদা দাবি করত। তিনিও যথাসাধ্য করতেন। অবশ্য খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের পরিচালিত ‘দিশারি ফাউন্ডেশন’ কর্তৃক তাঁকে সম্মাননা দেয়া হয়েছিল। খ্রিস্টীয় পাক্ষিক ‘স্বর্গমর্ত’ তাঁর জন্য বিশেষ একটি সংখ্যা প্রকাশ করেছিল।

আমার লেখাপড়ায় তাঁর সহযোগিতা ছিল। নানা পরামর্শ দিয়ে তিনি আমার প্রিয় দুলাভাইয়ে পরিণত হয়েছিলেন যেমন, তেমনি এমএ ডিগ্রিতে বই কেনার জন্য টাকা দিয়ে উৎসাহ প্রদান করেছিলেন। কিশোর’দার ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করেছি আমার ব্যক্তিগত প্রয়োজনে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে একসময় মিরপুর দশে বাস করতাম। তখন আমার মা-বাবা উভয়ে ছিলেন। তাঁরা সবসময় তাঁর বাসাতেই বেড়াতে যেতেন। কিশোর’দা আমার মা-বাবাকে মামা-মামী এবং ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করতেন। স্ত্রীর আত্মীয়-স্বজনকে মুহূর্তে আপন করার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল তাঁর। এভাবে আরও অনেক স্মৃতি, তর্ক-বিতর্ক, রাজনৈতিক সংলাপের কথা লেখা যেতে পারে। তবে তাঁর কন্যা সন্তানের মুসলিম বিবাহ নিয়ে কথা বলে শেষ করতে চাই।

এন্ড্রু কিশোর ছিলেন ধর্মীয় বিশ্বাসে খ্রিস্টান কিন্তু আপাদমস্তক অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিত্ব। শিল্পী-সাহিত্যিকদের জীবনে যে প্রগতিশীল চেতনা থাকা দরকার তা তাঁর মধ্যে বিকশিত হয়েছিল। এ জন্য একমাত্র কন্যা সংজ্ঞা যখন একজন মুসলিম ছেলের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হতে চেয়েছে তখন তিনি সম্মতি দিয়েছেন। এমনকি আমাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে কেউ কেউ মনোক্ষুণ্ন হলেও পরে কিশোর’দার উদারতাকে স্যালুট জানিয়েছেন।

৪.

আসলে এন্ড্রু কিশোর ছিলেন বিশাল হৃদয়ের মানুষ, মানবিক চেতনায় অনন্য। আর দেশপ্রেমের দৃষ্টান্তে অতুলনীয়। সিঙ্গাপুরে অবস্থানকালে কিশোর দা ডাক্তারকে বলেছিলেন, ‘তুমি আজই আমাকে রিলিজ করো। আমি আমার দেশে মরতে চাই, এখানে না। আমি কালই দেশে ফিরব।’ তিনি আমার দিদিকে কাঁদতে নিষেধ করেছিলেন। কারণ ব্যাধির স্বাভাবিক পরিণতি তিনি টের পেয়েছিলেন। এ জন্য মানসিকভাবে আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলেন। বাংলাদেশ হাই-কমিশনে ফোন করে বলেছিলেন, ‘কালই আমার ফেরার ফ্লাইট ঠিক করে দেন। আমি মরে গেলে আপনাদের বেশি ঝামেলা হবে, জীবিত অবস্থায় পাঠাতে সহজ হবে।’

ঠিক দেশে এসেই তিনি প্রয়াত হন। কিন্তু রেখে গেছেন আমাদের জন্য অসীম শূন্যতা। কিশোর দা আপনার জীবনের গল্প তো এখনো শেষ হয়নি। ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’ উড়িয়ে দয়ালের ডাকে কোথায় হারালেন? মৃত্যু হয়তো দেহের পিঞ্জর ভেঙে ডানা মেলেছে। তবু বেঁচে থাকার নিভৃত কুহক গান গেয়ে যায়, ‘সবাই তো ভালোবাসা চায়’, সেখানে আপনি ছিলেন ‘চিরকালের প্রেমের কাঙাল’।

লেখক : বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট; সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম; নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ এবং অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। email-writermiltonbiswas@gmail.com)

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *