যে স্বপ্ন নিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধ করি, 
 এখনও তা পায়নি দেশ বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব মো: সফিকুর রহমান ( ইপিআর)। 
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় ময়মনসিংহের সবেক ইপিআর ২নং হেডকোয়ার্টর ব্যাটলিয়ান কোম্পানিতে চারকুরীরত ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ১১নং সেক্টর কমান্ডার কর্নেল তাহের আলীর নেতৃত্বে দেশ স্বাধীকার উদ্দেশ্যে যুদ্ধে যুক্ত শুরু করেন।
 পাক-বানিহীর নির্যাতনে গর্জে উঠেলে বাঙ্গালীরা।
 মুক্তিযুদ্ধারা স্বপ্ন ভাসতো একটি স্বাধীন দেশ ও  বাঙ্গালী জাতির জন্য একটি লাল-সবুজের পতাকা উপহার দেয়া। 
নিজের জীবন ও পরিবার-পরিজনের মায়া ত্যাগ করে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে দেশ স্বাধীনের লক্ষ্যে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জন্ম হয় হাজারও হৃদয় বিদারক চিত্রের। 
চোখের সামনেই বুকের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত দেহ মুহূর্তেই লুঠে পড়ে মাঠিতে, কিন্তু সহযোদ্ধাদের লাশও নিয়ে যেতে পারেননি। 
যুদ্ধকালীন চিত্র মনে হলে এখনো অজোরে চোখের জল গড়ায় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের।
৩০ লক্ষ শহীদের ও ২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমহানীর মধ্য দিয়ে কেনা হয় একটি স্বাধীন দেশ-বাংলাদেশ। 
১৯৭১ সালের ২ মার্চ রাতে যুদ্ধ শুরু হলে সর্বপ্রথম পাকিস্তানী অফিসার আব্বাস সিদ্দিকীকে হত্যা করা হয়। 
এরপর জান্নাত খান, নায়েক সুবেদার রাজা মিরদাদ খান, হাবিলদার সালেহ মোহাম্মদ, হাবিলদার মীর মোহাম্মদ, হাবিলদার কামাল খান, নায়েক ফজলে এলাহীসহ ২০-৩৫ পাকিস্তানীকে বাঙ্গালী সৈনিকরা হত্যা করেন। 
পরে এপ্রিল মাসে প্রথম সপ্তাহে হেডকোয়ার্টার থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। 
কালিহাতী ব্রীজের আসার পর বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর সাথে দেখা হয় তাদের।
 তখন তিনি কোম্পানীর কমান্ডার সুবেদার হারিছুল হকের সাথে কথা বলে জানান,
টাঙ্গাইল হতে ৭-৮ জীপ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এ রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করে। 
তখন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী সাবেক করোটিয়া কলেজের মাঠে আমাদের ইপিআর’ প্রায় ২শ’ মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে যান এবং কলেজ প্রাঙ্গনে ক্যাম্প তৈরি করা হয়। 
সন্ধ্যার পর সব মুক্তিযোদ্ধা ডিফেন্সে চলে যায় এবং সারা সবাই সেখানে বিভিন্ন বাংকারে ডিউটি করেন। 
ফজরের আযানের পর পর ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানরত ডিফেন্স .এলাকায় প্রবেশ করা মাত্রই আমার সকল মুক্তিযোদ্ধা তাদের উপর অতর্কিত হামলা শুরু করি।
 ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে পাক-বাহিনীর সদস্য সংখ্যা। এক পর্যায়ে প্রায় ৭শ’ পাক হানাদার আক্রোমন শুরু করে বাঙ্গালীর উপর, শুরু হয় বিমান হামলা। 
সকাল ১১টায় পর্যন্ত চলে টানা সম্মুখমুখী মরণনপ্রাণ যুদ্ধ। 
জানা নেই কে প্রাণ নিয়ে ফিরবে। 
কোন মুক্তিযোদ্ধার তরতাজা প্রাণ যাবে এ লড়াইয়ে। 
সর্বশেষ পাক-বাহিনীর ৫০-৬০ জন নিহত ও কমপক্ষে শতাধিক আহত হন। 
এ লড়াইয়ে ২৫-৩০ বাঙ্গালী মুক্তিযোদ্ধা শহীদ।
তবে তাদের লাশ ঘটনাস্থলে ফেলে পিছ হঠতে হয়, বাকিদের। সেখান থেকে মাধবপুর থানার অন্তর্গত জলচত্র মিশনে চলে যাই। 
পুনরায় সেখানে ক্যাম্প তৈরি করে ১০দিন অবস্থান করা হয়। 
এরপর সেখান থেকে আমাদের ব্যাটলিয়ান কোম্পানী পাকিস্তানীদের সাথে যুদ্ধ করে জামালপুর, শেরপুর, জিনাইঘাতি, নকশি হয়ে ভারতের ঢালুতে প্রবেশ করি। 
এসব এলাকায় যুদ্ধকালে সময় লেগে প্রায় ১ মাস। সেখানে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর ক্যাপ্টেন বায়োজিৎ সিংহের অধীনে থাকি।
 ১১নং সেক্টর কমান্ডার কর্নেল তাহের আলীর অধীনে সাব-সেক্টর কমান্ডার ইপিআর’র সাবেক সুবেদার এবিএম আজিজুর হক, নায়েক সুবেদার হাবিজ উদ্দিন, হাবিলদার নঈশ উদ্দিন, হাবিলদার গোফরান, সায়েক বশর, নায়েক নবি হোসেন, সিপাহী জালাল আহমদ, আব্দুর রাজ্জাক, হাবিজুর রহমানসহ আমরা এ কোম্পানী প্রায় ২৫০জন বাঙ্গালী সৈনিক ভারতের কমলরাণী ক্যাম্পে ছিলাম। 
সেখানে থাকাকালে ভারতের মিত্র বাহিনীর ক্যাপ্টেন চৌহান আমাদের অফিসার ইনচার্জ ছিলেন। 
সিলেটের সুনামগঞ্জ মধ্যনগর-ধর্মপাশার নির্বাচিত এমপি আব্দুল হাকিম, নেত্রকোনা জেলার ৩নং আসনের নির্বাচিত এমপি জুবেদ আলী তালুকদার এমপি ও ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতা সামসুজ্জোহাসহ আরো অনেকেই আমার একসাথে ছিলাম। 
সামসুজ্জোহা বর্তমানে নেত্রকোনা জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন।
অনুভতি : তখন ঠগবগে যুবক ছিলাম। পাক-হানাদারের নির্যাতন থেকে মুক্তি পেতে, একটি স্বাধীন দেশ উপহার দেয়ার জন্য যুদ্ধে যুক্ত হই। তবে যেমন স্বাধীন দেশ চেয়েছিলাম, আজও তা পায়নি। 
 ৭১ সালের যুদ্ধ চলাকালে আলবদর ও রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নিয়েছিল। 
 পাক-বাহিনীর সাথে তাদের অঙ্গাঅঙ্গি সম্পর্ক ছিল। 
 কিন্তু আজ স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর দেখা যায় সেসব রাজাকারদের গাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ত দিয়ে কেনা লাল-সবুজের পতাকা ঝুছলে। 
যা আমাদের জন্য পাহাড় সম্য কষ্টের।  আমারা রাজাকারদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব শফিকুর রহমান বলেন, কালিহাতি ব্রীজের ডিফেন্সে যুদ্ধকালে আমাদের বাংকারের সিনিয়র সদস্য কিশোরগঞ্জ জেলার অধিবাসী মো. হাফিজুর রহমান পাক বাহিনীর গুলিতে নিহত হন।
  রাস্তা পড়ে ছিল উনার লাশ।  ত্রিমুখী আক্রমণ শুরু করে পাকিস্তানীরা। লাশ ক্যাম্পে নিয়ে আসতে পারিনী। 
চোখের জলে মুচার সুযোগও ছিল না। প্রায় এক কিলোমিটার পাক-বাহিনীর সাথে সরাসরি বন্দুক যুদ্ধ করে পালাতে হয় আমাদের। এছাড়া আমাদের ইপিআর’ও আরেক সদস্য সিলেটের ছাতক জেলার হাবিলদার বোরহানও মারা যান পাকা বাহিনীর গুলিতে। সেখানে ছিল তাদের সাথে শেষ দেখা। 
 আজো তাদের ক্ষত-বিক্ষত দেহের কথা মনে হলে চোখের জল আটকাতে পারি না।  মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিময় কথা গুলো আমাদের জীবনে অবিস্মরনীয়।  আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানেরা নতুন প্রজন্মের কাছে যুদ্ধের সঠিক তথ্য তুলে ধরবে এটাই কামনা করি। বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব মো: সফিকুর রহমান বর্তমানে বাংলাদেশ  মুক্তিযোদ্ধা সংসদ,গোলাপগঞ্জ উপজেলা কমান্ডের ২ বারের নির্বাচিত কমান্ডারের  দায়িত্ব পালন করছেন।

নির্বাহী সম্পাদক