Main Menu

ময়মনসিংহে‌ ‘হিজড়া সেজে’ চাঁদাবাজি করছেন অর্ধশতাধিক পুরুষ

ময়মনসিংহে পুলিশ ও প্রশাসনের নাকের ডগায় ‘নকল হিজড়া’ সেজে সড়কে এবং গণপরিবহনে চাঁদাবাজি করছেন অর্ধশতাধিক পুরুষ। এ নিয়ে অতিষ্ঠ পথচারীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষজন। সবচেয়ে বিপাকে পড়ছেন গণপরিবহনের যাত্রীরা। তাদের নানাভাবে হয়রানি করে টাকা আদায় করছেন সংঘবদ্ধ একটি গ্রুপের সদস্যরা।

হিজড়া জনগোষ্ঠীর সদস্য ও সংগঠনের নেতারা বলছেন, হিজড়া সেজে যারা চাঁদাবাজি করছেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। এটি একপ্রকার প্রতারণা ও অপরাধ। এ নিয়ে অস্বস্তিতে আছেন তারাও।

পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, নকল হিজড়াদের দ্রুত সময়ের মধ্যে শনাক্ত করা হবে। চাঁদাবাজির ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

শ্যামল নাম বদলে ‘শ্যামলী বাংলা’

ময়মনসিংহ নগরের মরাখোলা আবাসন পল্লিতে স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে বসবাস করেন এক প্রতিমা কারিগর। সম্প্রতি পেশা বদলে হিজড়া সেজে ‘শ্যামলী বাংলা’ নামে পাটগুদাম ব্রিজ মোড়ের বাসস্ট্যান্ড এলাকায় আরও কয়েকজনের সঙ্গে চাঁদাবাজি করছেন। চাহিদা অনুযায়ী টাকা না পেলে পথচারী ও যাত্রীদের করা হয় হয়রানি। হিজড়া সাজার কথা স্বীকার করে বাংলা ট্রিবিউনকে শ্যামলী বলেন, ‘আমার আসল নাম শ্যামল।’

কেন হিজড়া সেজেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আগে যে কাজ করতাম তার আয় দিয়ে সংসার চলে না। পেটের দায়ে হিজড়া সেজে রাস্তায় নেমেছি। এখন মানুষের কাছে হাত পেতে যা পাই, তাই দিয়ে কোনোমতে সংসার চলে। তবে কাউকে হয়রানি করি না। পাটগুদাম ব্রিজ মোড় বাসস্ট্যান্ড এলাকায় যারা টাকা তুলছেন, তারা কেউ হিজড়া নন। আমরা হিজড়া সেজেছি। একটি গ্রুপের সদস্য হয়ে কাজ করছি।’

গ্রুপের নাম কী, কারা চালাচ্ছেন এটি এমন প্রশ্নের জবাবে শ্যামল বলেন, ‘তা আপনারা খুঁজে বের করেন। নাম বললে আমাকে বিপদে পড়তে হবে। আমাদের গ্রুপের সদস্যরা দিনে যা আয় করেন, তার বেশিরভাগ টাকা গ্রুপের প্রধানকে দিতে হয়। কারণ না হয় তার অধীনে কাজ করতে পারবো না। বের করে দেবে। দিনে এক থেকে দেড় হাজার টাকা আয় হলে গ্রুপ প্রধানকে দেওয়ার পর ৫০০-৬০০ টাকা নিয়ে বাড়ি যাই। এই টাকা দিয়েও সংসার চলে না। তবু কোনোমতে চালিয়ে নিচ্ছি। এখানে যারা হিজড়া সেজেছেন সবাই মেয়েলি আচরণ করেন। আমাদের কেউ কাজ দিতে চায় না, একপ্রকার নিরুপায় হয়ে এখানে এসেছি।’

শ্যামলের শ্বশুর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মেয়ের জামাইয়ের হিজড়া সেজে চাঁদাবাজির বিষয়টি আমার জানা নেই। সে প্রতিমা তৈরি কাজ করে সংসার চালায় বলে জানি। তার স্ত্রী-সন্তান আছে। হিজড়া সেজে এমন প্রতারণা করা অনৈতিক। এটি মারাত্মক অপরাধ। আমি তার সঙ্গে কথা বলে এই পথ ছাড়তে বলবো।’

শুধু শ্যামল নন, পাটগুদাম আটানি পুকুরপাড় এলাকার সালাউদ্দিন নাম বদলে ‘প্রিয়াঙ্কা’ নামে হিজড়া সেজেছেন। একইভাবে শহীদুল ইসলাম ‘সন্ধ্যা’ নামে হিজড়া সেজে পুকুরপাড় এলাকায় টাকা তুলছেন।

আছে নকল হিজড়াদের সংস্থা

তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের সূত্র ধরে অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, আলোর পথে হিজড়া সমাজকল্যাণ সংস্থা নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছেন নগরের বাসিন্দা আলাউদ্দিন শেখ সালাম। তিনি বাস্তবে পুরুষ। নাম বদলে ‘সালমা’ নামে হিজড়া সেজেছেন। সংস্থার সভাপতি তিনি নিজেই। থাকেন নগরের নাজমা বোর্ডিংয়ের পাশের বাসায়। এই সংস্থার সদস্য ৮০ জন। এর মধ্যে ৫২ জন পুরুষ, বাকিরা হিজড়া। সংস্থার অর্ধশতাধিক পুরুষ হিজড়া নগরের বিভিন্ন পয়েন্টে চাঁদাবাজি করছেন। প্রকৃত হিজড়ারা পরিবহনে টাকা তোলেন।

এই সংস্থার সদস্য হিজড়া টুনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের সংস্থার বেশিরভাগ সদস্য পুরুষ। তারা হিজড়া সেজে সড়কে, বাসে, ট্রেনে ও পথচারীদের কাছ থেকে টাকা তুলছেন। তবে আমরা যারা হিজড়া তারা জোর-জবরদস্তি করে কারও কাছ থেকে টাকা নিই না। যে যা দেয় তা নিয়ে ফিরে আসি।’

প্রকৃত হিজড়া সংগঠন সেতু বন্ধন

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ময়মনসিংহের হিজড়া জনগোষ্ঠীর সংগঠন সেতু বন্ধন কল্যাণ সংঘের সাধারণ সম্পাদক রোজ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ময়মনসিংহে আমাদের সংস্থাটি হিজড়াদের প্রকৃত সংগঠন। এখানে কোনও নকল হিজড়াকে রাখা হয় না। ফলে নকল হিজড়ারা ভিন্ন সংগঠন করে আমাদের নাম ভাঙিয়ে সড়কে ও গণপরিবহনে চাঁদাবাজি করছেন। তাদের কারণে আমাদের বদনাম হচ্ছে। বাইরে বের হলে মানুষ আমাদের কাছে জানতে চায়, আসল নাকি নকল। এতে অস্বস্তিতে পড়তে হয়। লজ্জা পেয়ে যাই।’

তিনি বলেন, ‘একজন হিজড়া কখনও বিয়ে করতে পারে না। স্ত্রী-সন্তান থাকার প্রশ্নই আসে না। এ কারণে কেউ যদি বিয়ে করে এবং স্ত্রী-সন্তান থাকে তাকে হিজড়া বলা যায় না। নকল হিজড়াদের প্রতারণা ও চাঁদাবাজি বন্ধ করা উচিত। প্রশাসনের কর্মকর্তারা ইচ্ছে করলেই এসব বন্ধ করতে পারেন। কিন্তু আমাদের করার মতো কিছুই নেই। শুধু প্রতিবাদ জানাতে পারি। বাকি ব্যবস্থা পুলিশ ও প্রশাসনকে নিতে হবে।’

অতিষ্ঠ মানুষজন

পাটগুদাম ব্রিজ মোড়ের পথচারী কামাল হোসেন বলেন, ‘নকল হিজড়ারা সংঘবদ্ধভাবে একসঙ্গে থাকেন। তারা বেশি পরিমাণ চাঁদা দাবি করেন। চাহিদামতো টাকা না দিলে খারাপ আচরণ করেন। গালিগালাজ করার পাশাপাশি পরিবারের সদস্যদের সামনে অপদস্থ করেন। বাধ্য হয়ে টাকা না দিয়ে আর পারা যায় না।’

নগরের পরিবহনশ্রমিক রুমেল মিয়া বাংলা ট্রিবিউনকে, ‘নকল হিজড়ারা বাসের যাত্রীদের কাছে সর্বনিম্ন ২০ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত দাবি করেন। এই হিজড়াদের কারণে যাত্রী ও সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ। পুলিশ ও প্রশাসনের সামনে প্রতিদিন এমন ঘটনা ঘটছে। কিন্তু এ বিষয়ে কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছেন না তারা।’

নগরের ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্ট হৃদয় আহমেদ মোজাম্মেল বলেন, ‘নকল হিজড়াদের কারণে সবাইকে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। তারা কারও কোনও কথা শোনে না। চাহিদা অনুযায়ী টাকা না দিলে যাত্রীদের অপমান ও হয়রানি করেন। এটি বন্ধ করা জরুরি। তবে কে আসল আর কে নকল, তা বোঝা মুশকিল।’

কীভাবে হবে শনাক্ত

এ বিষয়ে ময়মনসিংহ আনন্দ মোহন কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোশাররফ হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে হিজড়া সাজার প্রবণতা বেড়েছে। এটি একপ্রকার প্রতারণা। হিজড়াদের জন্য সরকারি ব্যবস্থাপনায় আইডি কার্ডের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদেরকে নানা ট্রেডে প্রশিক্ষণ দিয়ে বিভিন্ন পেশায় যুক্ত করতে হবে। তখন নকল হিজড়ারা ধরা পড়ে যাবে।’

আইনি ব্যবস্থা নেবে পুলিশ

এ বিষয়ে জানতে জেলা পুলিশ সুপার কাজী আখতার উল আলমের মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল দিলেও রিসিভ করেননি।

তবে ময়মনসিংহ কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শফিকুল ইসলাম খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‌‘মানুষের জানমালের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব পুলিশের। সড়কে কোনও ব্যক্তি হয়রানি শিকার হবে, এটি মেনে নেওয়া যায় না। যে আইনবিরোধী কাজ করবে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। হিজড়া সেজে যারা চাঁদাবাজি করছে তাদের শনাক্ত করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

Leave a comment






এই বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

shuddhobarta24
Privacy Overview

This website uses cookies so that we can provide you with the best user experience possible. Cookie information is stored in your browser and performs functions such as recognising you when you return to our website and helping our team to understand which sections of the website you find most interesting and useful.