Home » ‘মাটির বিস্কুট’ সিলেটে বিলুপ্তির পথে

‘মাটির বিস্কুট’ সিলেটে বিলুপ্তির পথে

সিলেটে বিলুপ্তির পথে‘মাটির বিস্কুট’ ছিকর। কেউ বলে পোড়া মাটি আবার কেউ বলে মাটির বিস্কুট। পূর্বে ব্যাপক আকারে এ শিল্প উৎপাদন করা হলেও বর্তমানে সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার লালাবাজার এলাকায় এটি তৈরি হয়। সেখান থেকে সিলেট নগরের ঐতিহ্যবাহী আলী আমজদের ঘড়ি সংলগ্ন মৃৎশিল্প বিক্রেতাদের কাছে এখনো অল্প পরিমাণে এখনো আসে। বেশ কয়েক বছর পূর্বেও সিলেটের বিভিন্ন গ্রামগঞ্জের হাট বাজারে ছিকর পাওয়া গেলেও এখন আলী আমজদের ঘড়ি সংলগ্ন মৃৎশিল্প বিক্রেতাদের ছাড়া অন্য কোথাও পাওয়া দুষ্কর। বলা যেতে পারে প্রায় বিলুপ্তির পথে এ শিল্প। তবে যাঁরা ক্রয় করছেন তাদের অধিকাংশই যুক্তরাজ্যে প্রেরণ করার জন্য কিনে নিচ্ছেন বলে একাধিক বিক্রেতা জানিয়েছ

জানা যায়, ছিকর মূলত পাহাড়ি এঁটেল মাটি দিয়ে তৈরি করা হয়৷ এটি সর্বপ্রথম আশির দশকে হবিগঞ্জের পাহাড়ি অঞ্চল খ্যাত দিনারপুর পরগনার তৈরি করা হয়েছে। সেখানকার শব্দকর নামের পরিচিত হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন এটি প্রস্তুত করতেন। প্রথমে বিশাল গর্ত খুঁড়ে পাহাড়ের তলদেশ থেকে লম্বা বাঁশের সাহায্যে এক ধরনের মিহি মাটি সংগ্রহ করে পরবর্তীতে সারা রাত ভিজিয়ে রেখে নরম করা হত। তারপর তা কয়েক দফায় মাখিয়ে আরও মসৃণ করা হয়। যা ছাঁচে ফেলে মন্ড করা হয়। পরে এগুলো কাঠের হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে চ্যাপ্টা করা হয়। এরপর চাকু দিয়ে বিস্কুটের মতো ছোট ছোট করে টুকরা করা হয়। এরপর কাঁচা ছিকরগুলো রোদে দু-এক দিন শুকানোর পর এক ধরনের বিশেষ চুলায় এগুলো পোড়ানো হয়। পরে একটি মাটির হাঁড়ির নিচের অংশ ভেঙে সেখানে লোহার শিক দিয়ে তৈরি চালুনি রেখে ছিকরগুলো ওই চালুনির ওপর বসানো হয়। তারপর হাঁড়িটি একটি মাটির গর্তে ঢুকিয়ে ধানের তুষ দিয়ে আগুন জ্বালানো হয়। সতর্কতার সাথে শুধুমাত্র ছিকরের গায়ে ধোঁয়া লাগানো হয়। ঘণ্টা দুয়েক পর ছিকর কালচে বর্ণ ধারণ করে সুঘ্রাণ ছড়াতে থাকে। এরপর বাজারজাতকরণ করা হয়। কেউ কেউ নিজে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ফেরি করে বিক্রি করতো। আবার কেউ কেউ পাইকারি দামে বিভিন্ন দোকানে বিক্রি করা হতো।

জানা গেছে, পরবর্তীতে এটি সিলেট অঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় জনপ্রিয়তা অর্জন করে ফেলে। ফলে সিলেটের বিভিন্ন জায়গায় ছিকর তৈরি করা হতো। বর্তমানে সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার লালাবাজারে তৈরি করা হয়। ঐতিহ্য রক্ষায় এখন ছিকর তৈরি করা হচ্ছে বলে একাধিক ছিকর প্রস্তুতকারক জানিয়েছেন। সিলেট আলী আমজদের ঘড়ি সংলগ্ন এলাকায় একসময় ছিকর বিক্রি করতেন অমূল্য দেবনাথ। তিনি বলেন, ‘এক সময় আমিও ছিকর বিক্রি করতাম। এখন চাহিদা কম। তাই ছিকর বিক্রি করা বাদ দিয়ে মাটির তৈরি করা জিনিসপত্র বিক্রি করছ

তিনি আরও জানান, বিশেষ করে গর্ভবতী মহিলাদের কাছে ইহা একটি পছন্দনীয় সুস্বাদু খাদ্য ছিল। তাদের ধারণা ছিল এটা খেলে বিভিন্ন রোগ বালাই থেকে বেঁচে থাকা যাবে। তাই গর্ভবতী নারীরা বেশি এটিকে পছন্দ করে খেতেন। তবে আধুনিক শিক্ষিত মানুষরা ছিকর খাওয়াকে অস্বাস্থ্যকর ও রুচি বিরুদ্ধ বিবেচনা করেন। তাই আগের মতো ছিকর বিক্রি হয় না। বর্তমানে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা ধরে ছিকর বিক্রি করা হচ্ছে বলে জানান, সিলেটের আলী আমজদের ঘড়ি সংলগ্ন এলাকায় ছিকর বিক্রেতা ফখরুল ইসলাম।তিনি বলেন, ‘ছিকর আমাদের দাদা, বাবা বিক্রি করতেন। একসময় ছিকর বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছিলাম। তবে মাঝেমধ্যে ক্রেতা এসে খোঁজ করেন তাই আবার বিক্রি করছি। বর্তমানে আমাদের কাছে যেসব ছিকর আছে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা কেজি ধরে বিক্রি করি।’

তিনি আরও বলেন, আগে বেশি করে ছিকর কিনতাম। তবে সপ্তাহ সপ্তাহ লালাবাজারের অরবিন্দু আমাদের ৫-১০ কেজি এনে দেন। এখন ছিকর প্রায় বিলুপ্তির পথে।
দক্ষিণ সুরমা উপজেলার লালাবাজার এলাকার বাসিন্দা ববিতা রানী ছিকর তৈরি করেন। তিনি বলেন, এটি আমাদের পূর্বপুরুষ বানাতেন। আগে আমরা ব্যাপক আকারে ছিকর তৈরি করলেও এখন ঐতিহ্য ধরে রাখতে সামান্য তৈরি করি। চাহিদাও কম। মাঝেমধ্যে ফরমায়েস আসে বলে ববিতা জানান, মাঝেমধ্যে অর্ডার আসে। কেউ ৫ কেজি, কেউ ১০ কেজি অর্ডার করেন। তখন মূল দামের সঙ্গে বকশিসও দিয়ে থাকেন৷ মূলত ৫ কেজি ১০ কেজি যারা নেন তারা বিলেতে পাঠাতে এমন ফরমায়েশ দেন।

বর্তমানে এ শিল্প বিলুপ্তির পথে বলে উল্লেখ করে লালাবাজার এলাকার অরবিন্দ দাস বলেন, একসময় বাড়িতে এসে পাইকাররা নৌকা ও গাড়ি বোঝাই করে ছিকর নিয়ে যেতেন দূর-দূরান্তে। তখন সুদিন ছিল ছিকরের। দিন-রাত কাজ করেও আমাদের পূর্বপুরুষরা পাইকারদের চাহিদা মেটাতে পারতেন না। বর্তমানে ছিকরের অকাল চলছে। এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে রয়েছে

কিভাবে ছিকর তৈরি করা হয়, এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ছিকর তৈরিতে আসলে দক্ষতা লাগে। মাটি শুকানো ও পোড়ানোতেই আসল কারসাজি। ঠিকভাবে না হলে স্বাদ আর ঘ্রাণ কোনোটাই পাওয়া যায় না। ছিকনা মাটি তুলে আনাটাও গুরুত্বপূর্ণ কাজ। টিলায় গর্ত খুঁড়ে লম্বা বাঁশের সাহায্যে গভীর থেকে তুলে আনা হয় এ মাটি। রাতের বেলা মাটিগুলো একটি গামলায় নিয়ে পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয়। সারা রাত ভিজে মাটি নরম হলে ছাঁচে ফেলে প্রথমে তৈরি করা হয়। তারপর কাঠের হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে চ্যাপ্টা করা হয়। এরপর চাকু দিয়ে বিস্কুটের মতো ছোট ছোট করে টুকরা করা হয়। তবে গ্রাহক চাহিদা অনুযায়ী ললিপপ বা লজেন্স আকৃতির ছিকরও হয়ে থাকে। কাটার পর কাঁচা ছিকরগুলো রোদে দেওয়া হয়। দু-এক দিন শুকানোর পর এক ধরনের বিশেষ চুলায় এগুলো পোড়ানো হয়। তারপর একটি মাটির হাঁড়ির নিচের অংশ ভেঙে সেখানে লোহার শিক দিয়ে তৈরি চালুনি বসানো হয়। ছিকরগুলো ওই চালুনির ওপর বসানো হয়। তারপর হাঁড়িটি রাখা হয় একটি মাটির গর্তে। ধানের তুষ দিয়ে আগুন জ্বালানো হয় গর্তে। সতর্কতার সঙ্গে ছিকরের গায়ে শুধু ধোঁয়া লাগানো হয়। দুই ঘণ্টা পর ছিকর কালচে রং ধারণ করে। সুঘ্রাণ তৈরি হয়। তখন গ্রাহকদের কাছে তুলে দেওয়ার উপযুক্ত হয় পোড়া মাটি বা ছিকর মাটি। উইকিপিডিয়ার তথ্য বলছে, ছিকর একটি ফারসি শব্দ। ছিয়া মানে কালো আর কর মানে মাটি। ছিয়াকর শব্দটিই পরে ছিকর হয়ে গেছে। ক্ষৃধা নিবারণের জন্য নয়, বরং এক ধরণের অভ্যাসের বশে লোকজন তা খেয়ে থাকেন।

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *