Main Menu

কে পাগল বানালো ব্যাচসেরা এএসপি আনিসুলকে

তিনি একজন বিসিএস পুলিশ অফিসার ছিলেন। লেখাপড়া করেছিলেন দেশের স্বনামধন্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগে। অনার্সে তাঁর মেধাক্রম ছিলো প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয়। দেশের সেবা করার অদম্য আগ্রহ ছিলো এই তরুণের। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারতেন, অথবা দেশ ছেড়ে নিরাপদ জীবনের আশায় বিদেশেও পাড়ি জমাতে পারতেন কিন্তু দেশের মানুষের পাশে থাকবেন বলে তিনি বিসিএস পরীক্ষা দিলেন।
৩১ তম বিসিএস পরীক্ষায় পাস করে এএসপির চাকরিও পেয়ে গেলেন। এখানেও যথারীতি মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন এই তরুণ পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি তাঁর ব্যাচে প্রথম স্থান অধিকার করলেন, পুলিশি ভাষায় যাকে বলে কোর্স সিনিয়র। এই পদের আকাশচুম্বী সম্মান। এতক্ষণ যার কথা বলছিলাম তাঁর নাম আনিসুল করিম। তিনি বাংলাদেশ পুলিশের একজন সিনিয়র এএসপি ছিলেন। তবে, এই সাফল্য ও রোমাঞ্চকর গল্পগুলো এখন অতীত হয়ে গেছে। তিনি আর কোনদিন দেশের সেবা করার জন্য মুখিয়ে থাকবেন না। তাঁর দেশসেবার স্বপ্নগুলো ইতোমধ্যই কবরের গহীন অন্ধকারে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে!

মেধাবী এই পুলিশ কর্মকর্তার অকালমৃত্যু দেশে একটা সাময়িক ইস্যু তৈরি করবে সত্য তবে, তা আবার একসময় হাওয়ায় মিলিয়েও যাবে। হয়তো কেউ কেউ আটক হবেন, হয়তো বিচারও হবে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের। তবু কিছু প্রশ্ন বিবেককে দংশন করছে অনবরত। হত্যাকারীদের ফাঁসি দিলেই কি সব অপরাধ শেষ হয়ে যায়?

সিনিয়র এএসপি আনিসুল করিম তাঁর জীবনের বিনিময়ে আমাদের সামনে কিছু প্রশ্ন রেখে গেলেন। একটা বিসিএস পরীক্ষার মতো এতো প্রতিযোগিতার মধ্যে যিনি প্রথম হলেন, তিনি তো আর লবিং তদবির করে সেটা হননি। নিশ্চয়ই মেধাবী ছিলেন বলেই তিনি তার ব্যাচে প্রথম হওয়ায় বিরল গৌরব অর্জন করেছিলেন। কিন্তু সেই মেধাবীদের সেরা মেধাবীকে যখন পাগলের অভিযোগে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়, যখন পুলিশ অফিসার হওয়া সত্ত্বেও একদল বুনো পশুর হাতে নিরিহভাবে মৃত্যুবরণ করতে হয় সেটা অসংখ্য প্রশ্ন তৈরি করে বৈকি।

কে পাগল বানালো এএসপি আনিসুল করিম স্যারকে?

প্রশ্ন জাগে একজন শীর্ষ মেধাবী কর্মকর্তা হওয়া সত্ত্বেও তাঁর কর্মস্থল কেনো গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটে হয়নি। একজন কোর্স সিনিয়র হওয়া সত্ত্বেও তাঁর যথাযথ মূল্যয়ন কেনো হলোনা? কেনো নানাবিধ সামাজিক, মানসিক উদ্বিগ্নতা, বিষণ্নতা তাঁকে চেপে ধরেছিলো জগদ্দল পাথরের মতো? কেনো সিনিয়র এএসপি আনিসুল করিম স্যারের ছোট্ট বাচ্চার সামনে আমাদের আজীবন মাথা নিচু করে থাকতে হবে? কি জবাব দেবো তাঁর সদ্য বৈধব্যবরণকারী স্ত্রীকে? কেনো দেশকে একজন মেধাবী অফিসার হারাতে হলো?

শুনলাম সিনিয়র এএসপি আনিসুল করিম স্যারকে সার্কেল এএসপির পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। তাছাড়া তিনি পদোন্নতি বঞ্চিত ছিলেন। এই ঘটনাগুলোই তো একজন কর্মকর্তাকে হতাশায় নিমজ্জিত করার জন্য যথেষ্ট। এরপরেও মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা চলমান ছিলো। সর্বশেষ ভূমি কোর্সে না যাওয়ায় তাঁকে শোকজ দেওয়া হয়েছিলো। আগেই ভেঙ্গে ছিলেন, এসব ঘটনায় নিঃশেষ হয়ে ঝরে গেলে তরতাজা এক প্রাণ।

চোখের সামনে এসব নিষ্ঠুরতা দেখে মুখ বন্ধ রাখা খুব সহজ নয়। সারদায় প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম দেশের শত্রুদের খতম করার অভিপ্রায়ে। চাকরি তো জীবনের সব নয়! মনে প্রশ্ন জাগে ক্যাডার সার্ভিসের সব সেক্টর কি তাহলে শতভাগ আইনসিদ্ধ কাজ করছে? কোথাও কোনো অনিয়ম, দুর্নীতি নেই? ক্যাডার সার্ভিসের সব অফিসার কি তবে দুধে ধোয়া তুলসীপাতা হয়ে গেলেন? বাহ! চোখের সামনে কতজনকেই তো আঙুল ফুলে কলাগাছ হতে দেখলাম। কত অফিসারকেই তো অল্প কয়েক বছরেই বাড়ি-গাড়ির মালিক বনে যেতে দেখলাম। আপনারাও দেখেছেন নিশ্চয়। কই তাদের তো কিছু হয়না! সিরিয়াস অপরাধের সাথে সরাসরি জড়িত হওয়া সত্ত্বেও কত রাঘব-বোয়ালকেই তো দেখি বহাল তবিয়তে দাপুটে পদে চাকরি করছেন, অথচ বিন্দুমাত্র অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট না হয়েও কত অফিসারকে প্রয়াত আনিসুল করিম স্যারের মতো করুন পরিনতি বরণ করতে হচ্ছে। একজন তরুণ ও মেধাবী পুলিশ কর্মকর্তা কি অপরাধ করলেন যে তাঁকে পাগল হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হলো? এই প্রশ্নগুলো আজ আমার একার নয়। আমার দৃঢ় বিশ্বাস বাংলাদেশ পুলিশের দুই লক্ষাধিক সদস্যসহ লক্ষ লক্ষ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর হৃদয় উৎসারিত প্রশ্ন।

প্রশ্ন জাগে, গাজীপুরের সন্তানকে বরিশালেই পদায়ন করাটা কি খুবই জরুরি ছিলো? তিনি কি ডিএমপি/জিএমপি/ঢাকা রেঞ্জের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটে পদায়িত হওয়ায় যোগ্যতা রাখতেন না? তিনি কি এমন চুরি-ডাকাতি করেছেন যে তাঁকে তিলে তিলে কষ্ট দিয়ে পাগল বানিয়ে ছাড়তে হবে? মানুষের জীবনে সমস্যা থাকতেই পারে। পারিবারিক, সামাজিক, মানসিক, আর্থিক নানান কারণে একজন অফিসার হতাশায় নিমজ্জিত থাকতেই পারেন। আপনাদের উচিৎ ছিলো পরম মমতায় তাঁর পাশে দাঁড়ানো, মাথায় স্নেহের পরশ বুলিয়ে দেওয়া। দেখতেন এটা করতে পারলে এই তরুণ অফিসার আবারো মাথা তুলে দাঁড়াতেন স্বমহিমায়। অথচ তাঁকে সাহস না জুগিয়ে, আপনজনের মতো তার পাশে না দাঁড়িয়ে একঘরে করে দিলেন। ব্যাচমেট ও জুনিয়ররা যখন অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন ঠিক তখন তাঁকে ডাম্পিং করে দেওয়া হলো।

কথায় বলে শাসন করা তাঁকেই সাজে সোহাগ করে যে। অথচ ইদানিং সোহাগ করার লোকের বড়ই অভাব। সরকারি, বেসরকারি, স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানসহ প্রায় সর্বক্ষেত্রে সবাই শুধু শাসনটাই করতে শিখেছেন। আপনাদের দেখলে সত্যিই করুণা হয়! কি নির্লজ্জ বেহায়া আপনারা? কত ছোট মনের অধিকারী আপনারা? কেমনে এতবড় পদে আসীন হলেন? শাসন করতে চেয়েছিলেন, ফেল মারলেন তো! পারলেন কই? আপনাদের নির্লজ্জ বেহায়াপনার কষাঘাতে জর্জরিত হয়ে একজন মেধাবী জীবনাবসান হলো। আপনাদের ক্ষমতা থাকলে এখন তাঁকে শাসন করেন! নিহত আনিসুল করিম স্যার এখন আপনাদের শাসন, শোষণ ও খামখেয়ালীপনার সীমানা ছাড়িয়ে বহুদূরে চলে গেছেন। আপনাদের দেওয়া শোকজ/ডিপিগুলো ইতিহাসের মহাফেজখানায় সংরক্ষিত থাকবে জনম জনম ধরে যাতে আপনাদের সীমাহীন দায়িত্বহীনতা ও নিষ্ঠুরতার কাহিনী পরবর্তী প্রজন্ম জানতে পারে।

আচ্ছা, বুকে হাত দিয়ে বলুন তো কজন অফিসার শতভাগ আইনসিদ্ধ কাজ করছেন? কর্মজীবনে স্বচ্ছতা, নীতিনৈতিকতার মানদণ্ড বজায় রেখ চাকরি করছেন? এই লিখাটি প্রকাশের পরে আমাকেও পাতলা কাগজ ধরিয়ে দেওয়া হতে পারে। তবে আমি বিচলিত নই। সত্য ও ন্যায়ের কথা বলাতে আমার বিন্দুমাত্র জড়তা নেই। আল্লাহর রহমতে জীবনের প্রথম বিসিএসে ক্যাডার হয়েছি, কিছু একটা করে খেয়ে বেঁচে থাকবো ইনশাআল্লাহ। আমি সুস্থ মস্তিস্কে, সম্পূর্ণ স্বাভাবিকভাবেই বলছি, নিজেরা পাল্টান, ডিপার্টমেন্ট পাল্টে যাবে, দেশ উপকৃত হবে। ডিপার্টমেন্টের সদস্য ও অফিসারদের বঞ্চিত করবেন না প্লিজ। শুধু মুখে মুখে নয়, বাস্তবেও ন্যায়বিচার ও সাম্য প্রতিষ্ঠা করুন স্যার।

আপনাদের ক্ষমতা সারাজীবন থাকবে না। সবাইকে ডিপার্টমেন্ট ছেড়ে একদিন চলে যেতে হবে। ফোর্স ও অফিসারদের পোস্টিং, পদোন্নতিসহ কল্যাণ কর্মসূচি সাম্য ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে পুনঃবিন্যাস করুন স্যার। সদস্যদের মনে কষ্ট রেখে দেশ, দশ ও ডিপার্টমেন্টের কল্যাণ হতে পারে না, পারেনা, পারেনা।

সিনিয়র এএসপি আনিসুল করিম স্যারের বিদেহী আত্মা শান্তি পাক। আপনার কাছে ক্ষমা চাওয়ার ভাষা আমাদের নেই। খুনিদের কঠোর শাস্তি হোক। আর যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই মৃত্যুর ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছেন-সবার বিচার চাই। আর কোন কর্মকর্তা, কর্মচারী যেনো আনিসুল করিম স্যারের পরিণতি বরণ না করেন এটাই এখনকার প্রত্যাশা।

লেখক: মফিজুর রহমান পলাশ, সিনিয়র এএসপি, আরআরএফ, রংপুর

Leave a comment






এই বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

shuddhobarta24
Privacy Overview

This website uses cookies so that we can provide you with the best user experience possible. Cookie information is stored in your browser and performs functions such as recognising you when you return to our website and helping our team to understand which sections of the website you find most interesting and useful.