Home » তুরস্কের আয়া সোফিয়ার ঐতিহাসিক খুতবা

তুরস্কের আয়া সোফিয়ার ঐতিহাসিক খুতবা

তুরস্কের ঐতিহ্যবাহী আয়া সোফিয়া মসজিদে দীর্ঘ ৮৬ বছর পর ২৪ জুলাই পবিত্র জুমার নামাজ পড়া হয়। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়িপ এরদোয়ানের উপস্থিতিতে জুমার নামাজের ইমামতি করেন তুরস্কের ধর্মমন্ত্রী প্রফেসর ড. আলী এরবাশ। উসমানি রীতিতে কোরআনের আয়াত খচিত তরবারি হাতে ধর্মমন্ত্রী মিম্বরে আরোহণ করেন। খুতবাটি বাংলায় সংক্ষিপ্ত ও পরিমার্জিত ভাষান্তর করেছেন তুরস্কে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থী আহমাদ আমিন

আলহামদুলিল্লাহ, আজ আয়া সোফিয়ার গম্বুজ থেকে ‘আল্লাহু আকবার’, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ ও দরুদের মধুর ধ্বনি ভেসে আসার দিন। আজানের সুমধুর সুর আয়া সোফিয়ার সুউচ্চ মিনার থেকে ইথারে-পাথারে ছড়িয়ে পড়ার দিন। আজ খুশিতে চোখে আসা পানি নিয়ে নামাজে দাঁড়ানো, খুশু-খুজুর সঙ্গে রুকুতে যাওয়া ও কৃতজ্ঞতায় মহান আল্লাহর সামনে সিজদাবনত হওয়ার দিন। আজ বিনয় ও আত্মমর্যাদা প্রকাশের দিন। এমন একটি দিন যিনি আমাদের উপহার দিয়েছেন, যিনি জগতের সর্বোচ্চ মর্যাদাপূর্ণ স্থান মসজিদে আমাদের একত্র করেছেন এবং পুণ্যময় আয়া সোফিয়ায় আমাদের প্রবেশাধিকার দিয়েছেন, সেই আল্লাহর অসংখ্য শোকরিয়া আদায় করছি।

হাজার দরুদ ও সালাম সেই মহামানবের প্রতি, যিনি অনাগত আমাদের সুসংবাদ দিয়ে গেছেন নিন্মোক্ত ভাষায় : ‘কনস্ট্যান্টিনোপল একদিন বিজয় হবেই। সে বিজয়ে নেতৃত্বদানকারী সেনাপতি কত উত্তম! আর সে বিজয়ের সৈনিকরা কত উত্তম!’

শত-সহস্র সালাম বর্ষিত হোক প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি এবং তাঁর এই সুসংবাদের ভাগীদার হওয়ার জন্য পথে বেরিয়ে পড়া ইস্তাম্বুলের আধ্যাত্মিক রাহবার আবু আইয়ুব আনসারি (রা.)-এর প্রতি। সালাম বর্ষিত হোক সব সাহাবি ও তাবেয়ির প্রতি।

ইসলামে বিজয় মানে ভোগদখল নয়—আবাদ করা, ধ্বংস করা নয়—উৎকর্ষ সাধন করা। ইসলামের এই শিক্ষা বুকে ধারণ করে স্পেনে আগমনকারী সুলতান আলপ আরসলান ও এখানকার মাটিকে মাতৃভূমি হিসেবে গ্রহণ করে আমাদের কাছে আমানত হিসেবে রেখে যাওয়া শহীদ, গাজি ও ঈমানের নুরে এই ভূমিকে আলোকিতকারী আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শকদের প্রতি হাজার হাজার সালাম। বিশেষভাবে রহমত বর্ষিত হোক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিশিষ্ট বুজুর্গ আখ শামসুদ্দিন (রহ.)-এর প্রতি, যিনি ফাতিহ সুলতান মুহাম্মাদের মনোজগতে বিজয়ের অঙ্কুর রোপণ করেছিলেন। পহেলা জুন ১৪৫৩ সালে এই আয়া সোফিয়ায় প্রথম জুমার নামাজে তিনি ইমামতি করেছিলেন।

হাজারো সালাম, ফাতিহ সুলতান মুহাম্মাদের প্রতি। যিনি আল্লাহর ওপর ভরসা করে ইস্তাম্বুলে ইসলামের পতাকা উড্ডীন করেছিলেন। আয়া সোফিয়াকে আজকের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য যাঁরাই শ্রম দিয়েছেন সবার প্রতি সালাম।

আয়া সোফিয়া পনের শ বছর ধরে মানব ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। তাই এটি জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রজ্ঞা ও ইবাদতের অন্যতম কেন্দ্র। আয়া সোফিয়া মহান আল্লাহর দাসত্ব ও তাঁর কাছে নিঃশর্ত আনুগত্যের অন্যতম নিদর্শন। ফাতিহ সুলতান মুহাম্মাদ এই ইবাদতখানাকে কিয়ামত পর্যন্ত আবাদ রাখার জন্য ওয়াক্ফ করে গেছেন। আর ওয়াকফকৃত সম্পদে কারো হস্তক্ষেপ বৈধ নয়। সুতরাং ইতিহাসের পরম্পরায় আয়া সোফিয়া শুধু তুর্কি জাতির মালিকানাধীন কোনো সম্পত্তি নয়; বরং মুসলিম উম্মাহর সম্পদ।

আয়া সোফিয়াকে নতুন করে মসজিদ হিসেবে ব্যবহার করার অর্থ হলো, দীর্ঘ পাঁচ শ বছরের ঐতিহ্যে ফিরিয়ে নেওয়া। আয়া সোফিয়ায় নামাজ আদায়ের মধ্য দিয়ে গোটা পৃথিবী এই শিক্ষা লাভ করবে যে একত্ববাদ, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও উত্তম চরিত্রের ওপর প্রতিষ্ঠিত ইসলামী সভ্যতা কখনো নেতিয়ে পড়লেও সময়ের ব্যবধানে তা উৎকর্ষের চূড়ায় আরোহণের পথ খুঁজে বের করবে, ইনশাআল্লাহ। আয়া সোফিয়ায় আজানের সুমধুর সুর উচ্চারিত হওয়ার মধ্য দিয়ে বাইতুল মুকাদ্দাসসহ পৃথিবীর অন্য ‘ব্যথিত’ মসজিদগুলো ও সেখানকার অধিবাসীদের অন্তরাত্মা কিছুটা হলেও শান্তি পাবে। এই মসজিদকে নামাজিদের জন্য উন্মুক্ত করতে পারা তুুর্কি জাতির ঈমান ও দেশপ্রেমের পরিচায়ক। তুর্কিদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে ইশারা করছে তাদের এই অটল সিদ্ধান্ত।

ইসলামী সংস্কৃতিতে মসজিদগুলো একতা, সংহতি, ভ্রাতৃত্ব ও শান্তির উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। পবিত্র কোরআনে মসজিদ আবাদকারীদের সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘মসজিদগুলো শুধু সেসব লোক আবাদ করে, যারা আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস করে, জাকাত দেয় এবং আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করে না। আসলে এমন লোকদের ব্যাপারেই আশা করা যায় যে তারা হেদায়েতপ্রাপ্ত।’ (সুরা : তাওবা, আয়াত : ১৮)

যে মসজিদের মিনার থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসে না, যে মসজিদের মিম্বরে কেউ আরোহণ করে না, যে গম্বুজের নিচে গুনগুন আওয়াজ উঠে না, যে মসজিদের আঙিনায় মুসল্লিদের পদচারণ হয় না, তার চেয়ে কষ্টদায়ক দৃশ্য এই জগতে আর কী হতে পারে!

ইসলামবিদ্বেষীদের রোষানলে দুনিয়ার আনাচে-কানাচে আজ বহু মসজিদের দরজায় তালা ঝুলছে। এমনকি বোমা মেরে মসজিদ উড়িয়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটছে। মজলুম ও অসহায় মুসলিমরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। তাই দুনিয়াবাসীকে ফাতিহ সুলতান মুহাম্মাদের পাঁচ শ বছর আগের দেখিয়ে যাওয়া আদর্শ আজ স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। গোটা মানবতার প্রতি, বিশেষ করে মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর চালানো জুলুমকে আজই ‘থামো’ বলার সময় এসেছে।

আমাদের উচিত পুরো পৃথিবীতে ন্যায়ভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে সচেষ্ট হওয়া, শত সমস্যায় জর্জরিত লোকদের আশ্রয়স্থল হওয়া এবং জুলুম, অন্যায়, অবিচার, আর্তনাদ ও অসহায়ত্বের অমানিশায় ছেয়ে যাওয়া ভূখণ্ডে ইনসাফের পতাকা উড্ডীন করা। ঈমানি এই বিপ্লব আমাদেরই শুরু করতে হবে।

পুণ্যময় এই স্থানে দাঁড়িয়ে বিশ্ব মানবতাকে লক্ষ্য করে বলতে চাই, ‘হে মানবজাতি, আয়া সোফিয়া মসজিদ অন্য মসজিদের মতো আল্লাহর সব বান্দার জন্য সদা খোলা থাকবে। আধ্যাত্মিকতা, ঈমান, আল্লাহর ইবাদত ও সৃষ্টি নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে আয়া সোফিয়ার অবদান অন্য সময়ের মতো চলমান থাকবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে থাকা হৃদয়ের স্পন্দন এই ইবাদতখানার খেদমত করার তাওফিক দান করুন। এই মসজিদের যথাযথ মূল্যায়ন করার সৌভাগ্য আমাদের নসিব করুন।

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *