সাংবাদিক এটিএম তুরাবের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ঠিক এক বছর আগে, ১৯ জুলাই ২০২৪ এর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের উত্তাল মুহূর্তে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সিলেট নগরীর বন্দরবাজার এলাকায় পুলিশের গুলিতে নিহত হন এই তরুণ ও প্রতিশ্রুতিশীল সংবাদকর্মী।
দৈনিক নয়া দিগন্ত ও দৈনিক জালালাবাদ-এর রিপোর্টার হিসেবে দায়িত্বপালনের সময় গুলিবিদ্ধ হন তিনি।
ময়নাতদন্তে তার শরীরে ৯৮টি গুলির চিহ্ন পাওয়া যায়। লিভার, ফুসফুস ও মাথায় ছিল মারাত্মক ক্ষত। ঘটনাটি দেশজুড়ে ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি করলেও এক বছরেও মামলার বিচার শুরু হয়নি।
তুরাব হত্যাকাণ্ডে দায়ের করা মামলায় আসামি করা হয়েছে পুলিশের তৎকালীন ডিসি আজবাহার আলী শেখ, ওসি মঈন উদ্দিন, এসিএস মিজানুর রহমান, এবং আরও কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিকে।
আসামীদের মধ্যে এখন পর্যন্ত কেবল এডিসি সাদেক কাওছার দস্তগীর ও কনস্টেবল উজ্জ্বল কারাগারে। বাকিদের মধ্যে কেউ কেউ পলাতক, কেউবা রহস্যজনকভাবে এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে।
মামলার তদন্ত প্রথমে করে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ, পরে পিবিআই, এরপর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) অধীনে নেওয়ার জন্য আবেদন করেন মামলার বাদী তুরাবের বড় ভাই আবুল হাসান মো. আজরফ।
আইসিটির প্রসিকিউটর তারেক আবদুল্লাহর নেতৃত্বে মোহাম্মদ শাহ আলমসহ আইসিটি তদন্ত টিম সিলেটে দুই দফায় তদন্ত কাজ চালান। এ সময় তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন এবং কয়েকজন সাংবাদিকের সাথে কথা বলেন। দুই দফা তদন্তকালে তারা মামলার কয়েকজন সাক্ষীর সাথেও বিস্তারিত কথা বলেন।
মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে পিবিআইয়ের তদন্তকারী কর্মকর্তা মুহাম্মদ মুরসালিন গণমাধ্যমকে জানান, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ টি এম তুরাব হত্যা মামলার জোর তদন্ত চলছে। এ মাসেই তদন্ত শেষ করে তদন্ত টিম আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে রিপোর্ট জমা দিতে পারেন।
তিনি জানান,তাকে গত ৭ জুলাই ঢাকায় ডেকে নেয়া হয়েছিল। তার কাছ থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল নথিপত্র বুঝে নিয়েছেন। আগামী ২০ আগস্ট কারাগারে থাকা আসামি পুলিশের তৎকালীন এডিসি সাদেক কাওছার দস্তগীর ও পুলিশ কনস্টেবল উজ্জ্বলকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হবে। তাদের হাজিরার পরই তদন্ত রিপোর্ট ট্রাইব্যুনালে জমা দেয়ার প্রস্তুতি চলছে বলেও জানান মুরসালিন।
‘আমি মরার আগে ছেলের বিচার দেখে যেতে পারব তো?’- এই প্রশ্ন প্রতিদিনই রাষ্ট্র, সমাজ, সহকর্মী এবং সচেতন মহলের দিকে ছুঁড়ে দেন তুরাবের মা মমতাজ বেগম।
তুরাবের সহকর্মী দৈনিক জালালাবাদের সম্পাদক মুকতাবিস উন নূর বলেন, ‘তুরাবকে সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে। না হলে এতটা গুলি তার শরীরে লাগার কথা না। আমরা এর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই’।
ঐদিনের প্রত্যক্ষদর্শী ও মানবজমিন পত্রিকার ফটো সাংবাদিক মাহমুদ হোসেন বলেন, অনুদান, পদক এবং সেমিনারে তুরাব বন্দনার ঢল থাকলেও, হত্যাকাণ্ডের বিচার নিয়ে নেই কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি।
তুরাব, সিলেটের সাংবাদিকতার ইতিহাসে দায়িত্ব পালনকালে প্রথম শহীদ সাংবাদিক। তার সহকর্মী, শুভাকাঙ্ক্ষী এবং সাংবাদিক সংগঠন আজ স্মরণ করছেন তাকে গভীর শ্রদ্ধায়।
শহীদ সাংবাদিক তুরাবের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে সিলেটের সাংবাদিক সমাজ নানা কর্মসূচির আয়োজন করেছে।
সিলেট প্রেসক্লাব আয়োজন করেছে আলোচনা সভা, যেখানে সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ ও সহকর্মীরা তুরাবের স্মৃতি ও তার পেশাগত আদর্শ নিয়ে বক্তব্য দিবেন।
এ অনুষ্ঠানে প্রদান করা হয় ‘তুরাব পদক’, যা সাংবাদিকতায় সাহসিকতা ও সততার প্রতীক হিসেবে ভবিষ্যতে প্রতিবছর প্রদান করা হবে। একইসঙ্গে দোয়া মাহফিল আয়োজন করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ফটো জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন সিলেট বিভাগীয় কমিটির নেতৃত্বে সাংবাদিকদের একটি দল তুরাবের কবর জিয়ারত করেন শুক্রবার, অংশ নেন বিশেষ দোয়া মাহফিলে। পরে তার পরিবারের সঙ্গে দেখা করে সমবেদনা জানান এবং তার মায়ের খোঁজখবর নেন। শহীদমিনারে আজ সাংবাদিক সমাবেশের আয়োজন করেছে সংগঠনটি।
এটিএম তুরাবের মৃত্যু শুধু একটি পরিবার নয়, পুরো সাংবাদিক সমাজকে কাঁদিয়েছে। তুরাব আজ নেই, কিন্তু তার কলম ও ক্যামেরার সাহসিকতা আজীবন অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে সাংবাদিকতার নতুন প্রজন্মের জন্য।