Main Menu

অধ্যক্ষকে পদত্যাগে বাধ্য করতে ছাত্রদের নিয়ে আসেন শিক্ষকরাই

রাজধানীর সিটি কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক বেদার উদ্দিন আহমেদ অফিসিয়াল কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন নিজের রুমে। অন্য শিক্ষকরাও উপস্থিত ছিলেন সেখানে। সকাল ১১টার দিকে একদল তরুণ-তরুণী ঢুকে পড়েন সেখানে। ঢুকেই রুমের দরজা বন্ধ করে দেন তারা। এরপর সঙ্গে আনা একটি কাগজ সামনে এনে তাতে সই করার জন্য অধ্যক্ষকে চাপ দিতে থাকেন। এক শিক্ষক ছাত্রদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বলতে থাকেন, ‘আপনি পদত্যাগ করেন, তা না হলে ঝামেলা হবে’। অপমানের ভয়ে লিখিত কাগজে সই করেন অধ্যক্ষ বেদার উদ্দিন আহমদ।

এখানেই শেষ নয়। ছাত্রদের ওই দলটি অধ্যাপক বেদার উদ্দিনকে বাধ্য করে অন্য ছয় জন শিক্ষককে বরখাস্ত করতে।

গত ৭ আগস্ট এই ঘটনা ঘটে রাজধানীর সিটি কলেজে। ভুক্তভোগী শিক্ষকদের পক্ষ থেকে অভিযোগ উঠেছে, অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষের পদ দখল করতে কলেজের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মো. নেয়ামুল হক বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের নিয়ে এসে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেন।

অধ্যক্ষকে জোর করে পদত্যাগপত্রে সই নেওয়ার ঘটনার পর ওই দিনই সন্ধ্যায় (৭ আগস্ট) নেয়ামুল হক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব বুঝে নেন। সেদিনই কলেজের মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষক মোখলেছুর রহমানকে নিয়োগ দেন কলেজের উপাধ্যক্ষ পদে। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের চেয়ারে বসেই নেয়ামুল হক নোটিশ জারি করেন পরদিন ৮ আগস্ট জরুরি সভা করার জন্য।

অন্যদিকে ৮ আগস্ট ‘শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ’ হওয়ার কারণ দেখিয়ে গভর্নিং বডির চেয়ারম্যানের কাছে এক মাসের ছুটির আবেদন করেন অধ্যক্ষ বেদার উদ্দিন।

চেয়ারে বসেই সাত শিক্ষককে অবাঞ্ছিত ঘোষণার অফিস আদেশ

ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হয়ে অধ্যাপক কাজী নেয়ামুল হক গত ১১ আগস্ট অধ্যক্ষ এবং ছয় শিক্ষককে অফিস আদেশ দিয়ে কলেজে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন। এই ছয় শিক্ষক হলেন—বাংলা বিভাগের মো. দেলোয়ার হোসেন, মনোবিজ্ঞান বিভাগের ফরিদা পারভীন, ভূগোলের চৈতালী হালদার, হিসাববিজ্ঞান বিভাগের আহসান হাবিব রাজা ও একই বিভাগের কায়কোবাদ সরকার এবং ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষক আল ফয়সাল আকতার।

অবাঞ্ছিত হওয়া ছয় শিক্ষক বলছেন, তাদের ওপর অন্যায় করা হয়েছে। কোনও কারণ ছাড়াই তাদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে।

অধ্যক্ষকে পদত্যাগ করার ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী একাধিক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নামে বহিরাগত শিক্ষার্থীদের নিয়ে আসা হয়। তারা এসেই অধ্যক্ষের রুমে ঢুকে পড়ে। যেহেতু আমাদের শিক্ষকরা এই শিক্ষার্থীদের পেছনে রয়েছে, সে কারণে আমরা পরিস্থিতি সামাল দিতে পারিনি। আমাদের একজন শিক্ষকের উদ্যোগে বহিরাগতদের নিয়ে আসা হয়। সারা দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমন ঘটছে। বাধা দিতে গিয়ে অনেক শিক্ষক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এ কারণে কলেজের শিক্ষকরা অন্যায়ের বিরোধিতা করতে পারেননি। তারা নীরবতা পালন করেছেন। অধ্যক্ষকে সরিয়ে ওই দিনই অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষের পদে বসেছেন নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই। যারা পদে বসেছেন তাদের জিজ্ঞাসা করেন কোন আইনে তারা পদে বসেছেন?

তবে কলেজের বর্তমান প্রশাসনের দাবি, শিক্ষার্থীরাই ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক নেয়ামুল হককে অধ্যক্ষ ও মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক মোখলেছুর রহমানকে উপাধ্যক্ষ হিসেবে চেয়ারে বসিয়ে চলে যায়।

সূত্রের দাবি, একদল শিক্ষক ও সাবেক শিক্ষার্থীরা এই ঘটনায় জড়িত। অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয় অধ্যক্ষ বেদার উদ্দিন আহমেদকে। পাঁচ ঘণ্টা জিম্মি থাকার পর প্রাণভয়ে দায়িত্ব ছাড়তে বাধ্য হন তিনি।

কী বলছেন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ

ছাত্রদের নিয়ে এসে পদত্যাগ করানো এবং নিজ দায়িত্বে অধ্যক্ষ হওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অধ্যাপক নেয়ামুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে কোনও কথা বলবো না।’

এ বিষয়ে জানতে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও বক্তব্য পাওয়া যায়নি উপাধ্যক্ষ অধ্যাপক মোখলেছুর রহমানের।

গভর্নিং বডির সভাপতির অনিয়ম

৭ আগস্ট নিজেই ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের হয়ে চেয়ারে বসেন নেয়ামুল হক। পরে ২৭ আগস্ট অধ্যক্ষ বেদার উদ্দিনের আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগ দেখানো হয়। অর্থাৎ কাগজপত্র অনুযায়ী ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ যে ‘গায়ের জোরে’ পদে বসেছেন তা স্পষ্ট।

তবে মো. নেয়ামুল হককে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এবং মোখলেছুর রহমানকে ভারপ্রাপ্ত উপাধ্যক্ষ নিয়োগ গত ২৭ আগস্ট বৈধ করেছেন ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার। ঢাকার ওই সময়ের বিভাগীয় কমিশনার সাবিরুল ইসলাম কলেজটির সভাপতি ছিলেন সরকারি আদেশ অনুযায়ী। তাকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করায় তিনি এখন আর কলেজটির সভাপতি পদে নেই।

নিয়োগ বিধিমালা অনুযায়ী, স্বঘোষিত অধ্যক্ষ হওয়া এবং পরে বিভাগীয় কমিশনারের মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া দুটোই নিয়মবহির্ভূত। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শিক্ষক নিয়োগের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার বিধিতে অধ্যক্ষ নিয়োগের ধারা ৪(ক)-এর উপধারা ৩(i)-এ বলা হয়েছে, কলেজের অধ্যক্ষের অবর্তমানে উপাধ্যক্ষ অথবা জ্যেষ্ঠতম পাঁচ জনের মধ্যে যেকোনও একজনকে দায়িত্ব দিতে হবে। সেই সঙ্গে ছয় মাসের মধ্যে বিধি অনুযায়ী পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে অধ্যক্ষ নিয়োগ করতে হবে।

ধারা ৫-এ বলা হয়েছে, অধ্যক্ষ নিয়োগের ক্ষেত্রে কলেজের গভর্নিং বডির সভায় প্রার্থীর নাম উপস্থাপন করতে হবে। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে অব্যাহতি দিয়ে অধ্যক্ষ পদে আগ্রহী প্রার্থী নন এমন একজনকে দায়িত্ব দিতে হবে। পরবর্তীতে ভারপ্রাপ্ত সেই অধ্যক্ষ নতুন অধ্যক্ষকে নিয়োগের সব কার্যক্রম সম্পন্ন করবেন। এই নীতিমালা অনুযায়ী বিভাগীয় কমিশনার অধ্যক্ষ নিয়োগ দিতে পারলেও উপাধ্যক্ষ নিয়োগের কোনও বিধান নেই।

কিন্তু এসব বিধিমালা লঙ্ঘন করে কীভাবে সিটি কলেজে অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ নিয়োগ হলো– জানতে চাইলে ঢাকার সাবেক বিভাগীয় কমিশনার, কলেজটির ওই সময়ের সভাপতি মো. সাবিরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি তো এখন সভাপতি নেই।’

আপনি যখন সভাপতি ছিলেন তখনকার ঘটনা, কীভাবে এমনটা ঘটলো– প্রশ্ন করা হলে সাবিরুল ইসলাম বলেন, ‘তখন অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সভাপতি ছিলাম। অনেক প্রতিষ্ঠানে অনেক অভিযোগ ছিল। এসব তো এখন কাগজপত্র না দেখে বলতে পারবো না। এছাড়া অধ্যক্ষকে পদত্যাগ করানোর বিষয়ে আমি কোনও বক্তব্য দিতে পারবো না।’

প্রতিকার দাবি

পদত্যাগে বাধ্য হওয়া অধ্যক্ষ গত ১০ আগস্ট রাজধানীর ধানমন্ডি থানার জিডি ও বিভিন্ন দফতরে আবেদন দিয়ে তার সঙ্গে ঘটে যাওয়ার ঘটনাগুলোর প্রতিকার চেয়েছেন।

ওই দিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বেদার উদ্দিন আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘আমি পরিস্থিতির শিকার হয়ে নিজের জীবন বাঁচাতে কোনও রকমে একটা সই দিয়েছি। নিয়ম ছিল সভাপতির কাছে পদত্যাগপত্র দেওয়ার। কিন্তু তরুণ-তরুণীদের আগে থেকে লিখে আনা পদত্যাগপত্রে লেখা ছিল ‘যথাযথ কর্তৃপক্ষ’। কলেজের শিক্ষকরা এর সঙ্গে জড়িত না থাকলে আগে থেকেই কীভাবে পদত্যাগপত্র লিখে আনা সম্ভব হলো? আরও ছয় জন শিক্ষককে তারা কীভাবে চিনেছে যে তাদের সাময়িক বরখাস্ত করাতে আমাকে বাধ্য করা হলো? কোনও বিধিবিধান না মেনেই যেদিন আমাকে জোর করে পদত্যাগ করানো হলো, সেদিনই ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ নিজে নিজেই চেয়ারে বসে গেলেন। তার মানে আগে থেকেই সব ঠিক করে ছাত্র বা তরুণ-তরুণীদের ডেকে আনা হয়েছে।”

তিনি বলেন, ‘শুধু আমার ক্ষেত্রে নয়, দেশের প্রায় বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে একই ঘটনা ঘটেছে। এর প্রতিকার হওয়া জরুরি। আমাকে সামাজিকভাবে হেয় করা হয়েছে। এই ঘটনায় ছয় শিক্ষককেও হেয় করা হয়েছে। আমরা এর প্রতিকার চাই। প্রতিষ্ঠানের সভাপতি চাইলে এর একটা সুরাহা করতে পারতেন, তিনি করেননি।’

বেতন বন্ধ

বর্তমান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ চেয়ারে বসেই সাবেক অধ্যক্ষ বেদার উদ্দিন আহমেদসহ সাময়িক বরখাস্ত করা ছয় শিক্ষকের বেতন বন্ধ করে দিয়েছেন। এতে পরিবার নিয়ে তারা অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়েছেন। সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন সবাইকে বিষয়টি জানালেও তারা এখনও কোনও প্রতিকার পাননি।

Google News Logoবাংলা ট্রিবিউনের খবর

Leave a comment






এই বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

shuddhobarta24
Privacy Overview

This website uses cookies so that we can provide you with the best user experience possible. Cookie information is stored in your browser and performs functions such as recognising you when you return to our website and helping our team to understand which sections of the website you find most interesting and useful.