Main Menu

পরিবর্তন করা হলো কানাডার অভিবাসননীতি

সাম্প্রতিক সময়ে কানাডার অভিবাসন নীতিতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু পরিবর্তন এসেছে। এই পরিবর্তনগুলো কানাডায় আছেন বা আসতে চান এমন আন্তর্জাতিক ছাত্র, পর্যটক, অস্থায়ী কর্মী সবার সিদ্ধান্ত ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাকে প্রভাবিত করবে। কানাডার অভিবাসন ব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরেই তাদের জাতীয় পরিচয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে, যেখানে বহু সংস্কৃতিবাদ এবং অন্তর্ভুক্তি দেশটির মূলভিত্তি হিসেবে কাজ করছে।

বিশেষত, আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী, পর্যটক, এবং অস্থায়ী কর্মীদের কানাডায় স্বাগত জানানো হয়েছে, যা দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করেছে এবং বৈশ্বিক সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে, কানাডার অভিবাসন এবং ভিসা প্রোগ্রামগুলোর কিছু কাক্সিক্ষত পরিবর্তন রাজনৈতিক আলোচনায় কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করছে, যা ২০২৫ সালের ফেডারেল বা জাতীয় নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর প্রশাসন এই পরিবর্তন আনয়নে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং এই পরিবর্তনগুলো কানাডীয় ও অকানাডীয় উভয়ের মধ্যেই মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে, যা দেশের ভবিষ্যতের অভিবাসন নীতি নিয়ে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।

যারা কানাডার অভিবাসন ব্যবস্থার বিভিন্ন পরিবর্তন নিয়ে ভাবছেন, তাদের জন্য আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী প্রোগ্রাম থেকে শুরু করে পর্যটক ভিসা, অস্থায়ী কাজের পারমিট এবং পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশন কাজের পারমিটের সাম্প্রতিক পরিবর্তনগুলো নিয়ে একটি তথ্যভিত্তিক আলোচনা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বলে মনে করছি। এই পরিবর্তনগুলোর ফলে সৃষ্ট প্রভাব, রাজনৈতিক পরিবেশের ওপর এর প্রভাব ইত্যাদি এই প্রবন্ধে সহজভাবে আলোচনা করার চেষ্টা করব।

প্রথমে, আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী প্রোগ্রামের পরিবর্তনের দিকে মনোযোগ দেওয়া যাক। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কানাডার আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীনীতি ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। গত এক দশকে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে, যা কানাডাকে গ্লোবাল এডুকেশন মার্কেটের শীর্ষস্থানে নিয়ে গেছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১০ সালে কানাডায় আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল প্রায় ২৪০,০০০, যা ২০২১ সালের মধ্যে বেড়ে দাঁড়ায় ৬২২,০০০-এ।

এটি শুধু শিক্ষা খাতে নয়, সামগ্রিক অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলেছে। আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা প্রতিবছর কানাডার অর্থনীতিতে প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলার যোগ করে, যা বিশ্ববিদ্যালয় এবং স্থানীয় অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অধিক সংখ্যক বিদেশী শিক্ষার্থীর কানাডায় আসার অনুমতি দেওয়ার বিপক্ষে কানাডিয়ানরা তীব্র প্রতিবাদ করে আসছেন গত কয়েক বছর ধরে।

এই লাখ লাখ শিক্ষার্থীর একটা বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীই আসছেন মূলত কানাডার অন্টারিও প্রদেশে এবং তাদেরও একটি বড় সংখ্যা বৃহত্তর টরন্টো শহরে অবস্থিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তি হয়েছিলেন। দেখা গেছে, এই বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর চাপে কানাডার আবাসন সংকট তীব্র হয়েছে, বাড়ি ভাড়া বেড়ে গেছে এবং স্থানীয়রা সার্বিক জীবনমানের অবনতির অভিযোগ করেছেন। আইনশৃঙ্খলার ক্রমাবনতি ও নাগরিকদের মধ্যে শিষ্টাচারের অভাবের জন্য অনেকেই এই বিদেশী শিক্ষার্থীদেরকেই দায়ী করেছেন।

এটি সত্য যে, করোনাভাইরাস মহামারির সময় লাখ লাখ বিদেশী শিক্ষার্থী, বিশেষত ভারতীয় শিক্ষার্থীরা কানাডায় এসেছে, এবং তাদের অনেকেই পড়ালেখার চাইতে কানাডায় থেকে যাওয়ার সুযোগ কাজে লাগানোকে প্রাধান্য দিয়েছে। মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত শিক্ষার্থীদের এই বাঁধভাঙ্গা জোয়ারে বাসা ভাড়া বেড়ে গেছে কয়েকগুণ; অন্যদিকে ধনাঢ্য শিক্ষার্থীদের বাড়ি কেনার প্রবণতায় বাড়ির দামও বেড়ে গেছে।
সঙ্গে যোগ হয়েছে চাহিদার বিপরীতে সরবরাহের অসামঞ্জস্যতার কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির অসহনীয় মূল্যবৃদ্ধি। উল্লেখ্য, কানাডা তার নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রীর বেশিরভাগই আমেরিকা, মেক্সিকোসহ দক্ষিণ আমেরিকার নানা দেশ থেকে আমদানি করে, যা অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দিয়েছে। করোনা মহামারির সময়ে যখন পশ্চিমারা অনেকটাই নিরাপত্তার খাতিরে ঘরে নিজেদের আটকে রেখেছিলেন, তখন উবার, ট্যাক্সি চালানোর এবং খাবার সরবরাহের মতো কাজগুলো অনেক সহজলভ্য হয়ে যায় এবং মূলত আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা এই কাজগুলো করা শুরু করে।

অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারও সেই সময় আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা ঘণ্টায় ২০ ঘণ্টার বেশি কাজ করতে পারবে না, এই নিয়ম তুলে দেয়। আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের এই কাজ ও আয় করার বিপুল সুযোগ দেখে লাখ লাখ আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী পরবর্তী কয়েক বছরে কানাডায় আসে। কিন্তু করোনা মহামারি শেষ হওয়ার পর কানাডিয়ানরা যখন আবার কাজে আসতে থাকে, তখন কাজের তীব্র সংকট তাদের বিক্ষুব্ধ করে। ফলে, সরকার গত কয়েক মাসে বেশ কিছু পরিবর্তন এনেছে এই খাতে।

সাম্প্রতিক এই পরিবর্তনগুলো অনেক আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর জন্য সমস্যার কারণ হয়ে উঠেছে। উদাহরণস্বরূপ, নতুন নিয়ম অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা অফ-ক্যাম্পাসে প্রতিসপ্তাহে সর্বাধিক ২০ ঘণ্টা কাজ করতে পারবে, যেখানে করোনাকালীন সময়ে এই সীমা ছিল ন্যূনতম ৪০ ঘণ্টা। টরন্টো এবং ভ্যাঙ্কুভারের মতো শহরগুলোতে উচ্চ জীবনযাত্রার খরচ বিবেচনায় রেখে এই সীমাবদ্ধতা আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য আর্থিক চাপ বাড়িয়েছে।

এছাড়া, কিছু শিক্ষার্থীর জন্য কাজের পারমিট পেতে কঠোর বিধি প্রয়োগ করা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হলো, শুধু সরকার অনুমোদিত ও নির্ধারিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে স্নাতক করা শিক্ষার্থীরাই পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশন কাজের পারমিট (চএডচ) পাওয়ার যোগ্য হবে এবং আবেদনকারীর সবাই সেই অনুমতি পাবে, এমনটারও নিশ্চয়তা আর থাকছে না। ২০২৩ সালের আগে, অধিকাংশ শিক্ষার্থী চএডচ-এর সুবিধা পেত, যা তাদের স্নাতকোত্তর শিক্ষার পরে তিন বছর পর্যন্ত কানাডায় কাজ করার সুযোগ দিত।

এছাড়া আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের ভিসা দেওয়ার বিষয়েও সরকার নতুন ঘোষণা দিয়েছে। এই বছর থেকে বাৎসরিক সর্বোচ্চ ৩ লাখ ৬৪ হাজার আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীকে ভিসা দেওয়া হবে, যা গতবছর ছিল প্রায় ৫ লাখ ৬০ হাজার। এই সংখ্যা প্রতিবছরই পর্যালোচনা করা হবে। কিছু প্রাইভেট কলেজের ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীরা কোনো প্রকার কাজের সুযোগ পাবেন না এবং যেসব আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের স্বামী বা স্ত্রী মাস্টার্স, পিএইচডি বা অন্য কোনো কারিগরি শিক্ষায় ভর্তি হবেন, তারাই কাজের অনুমতি পেতে পারেন, বাকিরা পাবেন না। ফলে, অনেক শিক্ষার্থী পূর্বে বিদ্যমান কিছু সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে, যা আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অনিশ্চয়তা বাড়িয়েছে।

উচ্চশিক্ষার কাজের পারমিট প্রোগ্রামেও একইভাবে কঠোর পরিবর্তন এসেছে। আগে আন্তর্জাতিক গ্র্যাজুয়েটরা সহজেই তাদের পড়াশোনা থেকে কর্মজীবনে প্রবেশ করতে পারত পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশন ওয়ার্ক পারমিটের (চএডচ) মাধ্যমে। ২০২০ সালে, প্রায় এক লাখ আন্তর্জাতিক গ্র্যাজুয়েট চএডচ পেয়েছিল, যাদের অনেকেই পরবর্তীতে স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গিয়েছিল।

বর্তমানে আরও কঠোর যোগ্যতার শর্তাবলি, যেমন- নির্ধারিত ও নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করার শর্ত এই পথটিকে জটিল করেছে। ছোট বা ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের জন্য স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার রাস্তা এখন অনেক অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে। এই পরিবর্তন অনেকের মাঝে হতাশার সৃষ্টি করেছে, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা মনে করেন যে, এখন সিস্টেমটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্র ও প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে ঝুঁকে গেছে।

STEM প্রোগ্রামের গ্র্যাজুয়েটরা, যা প্রায়ই কানাডার অর্থনৈতিক অগ্রাধিকারের সঙ্গে মানানসই কাজ করার অনুমতি পাচ্ছেন সহজে, অন্যদিকে শিল্পকলা, মানবিক বা সামাজিক বিজ্ঞান থেকে স্নাতকরা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছেন। সরকার প্রোগ্রামটি পুনরায় পর্যালোচনা করার এবং এটিকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তবে অনেকেই আশঙ্কা করছেন যে, ক্ষতি ইতোমধ্যেই হয়ে গেছে।

দীর্ঘমেয়াদে এই পরিবর্তনগুলো আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের কানাডাকে তাদের পড়াশোনার গন্তব্য হিসেবে বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত করতে পারে, যা শিক্ষার্থী নাম লেখানোর সংখ্যা এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত অর্থনৈতিক অবদানের হ্রাস ঘটাতে পারে।

এখানে উল্লেখ্য, এই পরিবর্তনগুলো সরাসরি কানাডার আসন্ন ফেডারেল নির্বাচনের সঙ্গে সংযুক্ত। বিশেষ করে শহুরে এলাকায় আবাসন সংকট এবং চাকরির বাজারে চাপের কারণে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের প্রতি জনসাধারণের দৃষ্টিভঙ্গি রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বিরোধী দলগুলো এই ইস্যুটি তুলে ধরেছে, যুক্তি দিয়েছে যে, আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা আবাসন সংকট এবং সামাজিক সেবাগুলোর ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করছে।

এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে কানাডা বাড়ির মূল্য গড়ে প্রায় ১১.৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যার প্রধান কারণ অভিবাসী এবং শিক্ষার্থীদের চাহিদা। এই মূল্যবৃদ্ধি টরন্টো শহরে আরও অনেকগুণ বেশি। বাংলাদেশী মুদ্রায় ১০ কোটি টাকার নিচে টরন্টো এবং আশেপাশের শহরগুলোতে বসবাসযোগ্য ন্যূনতম সুবিধার কোনো আবাসন কেনার সুযোগ নেই বললেই চলে।

এই পরিস্থিতি ট্রুডোর প্রশাসনকে কিছু নিয়ম কঠোর করতে বাধ্য করেছে, যাতে তারা আসন্ন নির্বাচনে আবাসন এবং চাকরির বাজারে উদ্বিগ্ন ভোটারদের মন জয় করতে পারে। ট্রুডোর অভিবাসন বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি স্বাভাবিকভাবেই তাই তার প্রশাসনের প্রথম দিকের তুলনায় অনেকটাই পরিবর্তিত হয়েছে। ২০১৫ সালে যখন তিনি প্রথম ক্ষমতায় আসেন, তখন তার অভিবাসন নীতি ছিল প্রগতিশীল এবং উন্মুক্ত।

সিরিয়ার শরণার্থীদের স্বাগত জানানো এবং অভিবাসনের কোটার ব্যাপক বৃদ্ধির মাধ্যমে তার সরকার একটি উদারনীতি অনুসরণ করেছিল। উদাহরণস্বরূপ, ২০২১ সালে কানাডা প্রায় ৪ লাখেরও বেশি নতুন অভিবাসীকে স্বাগত জানায়, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সংখ্যা ছিল।

তবে অর্থনৈতিক সংকট, আবাসনের সমস্যাগুলো এবং চাকরির বাজারের চ্যালেঞ্জ ট্রুডোকে তার অভিবাসন নীতিতে আরও সতর্ক হওয়ার দিকে ধাবিত করেছে। যদিও তিনি এখনও বৈশ্বিক প্রতিভাদের কানাডায় স্বাগত জানানোকে সমর্থন করছেন, সাম্প্রতিক সীমাবদ্ধতাগুলো দেখায় যে, তার অভিবাসন নীতি আগের তুলনায় অনেক বেশি হিসেবি এবং নিয়ন্ত্রিত হয়ে উঠেছে।

পর্যটক ভিসার ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক কিছু পরিবর্তন এসেছে, যা কানাডার মহামারি পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ২০১৯ সালে, কানাডায় প্রায় ২২.১ মিলিয়ন আন্তর্জাতিক পর্যটক এসেছিল, যারা কানাডার অর্থনীতিতে প্রায় ১০৪.৯ বিলিয়ন ডলার অবদান রেখেছিল। তবে মহামারির কারণে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার ফলে পর্যটনের ওপর বড় আঘাত আসে।

২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে, পর্যটক ভিসার ব্যাকলগ প্রায় ১.৮ মিলিয়ন আবেদনে পৌঁছেছিল, যা সরকারকে ভিসা প্রক্রিয়া আধুনিকায়নের দিকে ধাবিত করে। কম ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম চালু করা হয়েছে, যাতে ভিসা প্রক্রিয়াটি দ্রুততর হয়। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং জাপান থেকে আসা আবেদনকারীদের জন্য ভিসা প্রক্রিয়া অনেকটাই সহজ করা হয়েছে।
তবে উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে আবেদনকারীদের জন্য ভিসা পেতে আরও বেশি সময় এবং জটিলতা দেখা দিয়েছে। কানাডার পর্যটন খাতের জন্য, বিশেষ করে আতিথেয়তা এবং ক্ষুদ্র ব্যবসাক্ষেত্রের এই পরিবর্তনগুলোকে নাগরিকগণ স্বাগত জানিয়েছেন, কারণ এটি মহামারি থেকে দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের একটি সম্ভাব্য পথ প্রদান করছে। তবে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষেত্রে ভিসাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে যে কঠোরতা দেখা যাচ্ছে, তা এই পরিবর্তনগুলোর একটি নেতিবাচক দিক হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে।

অতীতে কানাডার ভিসা নীতিগুলো তুলনামূলকভাবে সহজ এবং সহানুভূতিশীল ছিল, যা দেশের অতিথিপরায়ণতার পরিচায়ক হিসেবে বিবেচিত হতো। এই সাম্প্রতিক পরিবর্তনগুলো কিছু ক্ষেত্রে কানাডার বৈশ্বিক স্বাগত নীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর আবেদনকারীদের ক্ষেত্রে। অস্থায়ী কাজের পারমিটের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয়েছে, যা শ্রমবাজারের সংকট এবং বিদেশী শ্রমিকদের শোষণ সংক্রান্ত বিষয়গুলোকে প্রতিফলিত করছে।

কানাডার অস্থায়ী বিদেশী কর্মী প্রোগ্রাম দীর্ঘদিন ধরে শ্রমবাজারের ঘাটতি পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ২০২১ সালে, কানাডায় প্রায় ১ লাখ অস্থায়ী বিদেশী কর্মী এসেছিলেন, যারা কৃষি, নির্মাণ এবং স্বাস্থ্যসেবা ক্ষেত্রে কর্মরত ছিলেন। তবে নতুন নিয়মের অধীনে নিয়োগকর্তাদের আরও কঠোর শর্ত পূরণ করতে হবে এবং প্রমাণ দিতে হবে যে, তারা স্থানীয় কর্মী খুঁজে পাচ্ছে না।

এছাড়াও, কিছু খাতে অস্থায়ী কর্মীদের ওপর নির্ভরতা কমাতে সরকার উদ্যোগ নিয়েছে, যা দেশের কর্মী ঘাটতি মেটাতে স্থানীয় শ্রমিকদের উৎসাহিত করার একটি প্রচেষ্টা। কর্মীদের জন্য, পরিবর্তনগুলো মিশ্র প্রতিক্রিয়া এনেছে। ইতিবাচক দিক হলো- সংস্কারগুলোতে আরও শক্তিশালী সুরক্ষা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। যেমন- নিয়োগকর্তাদের ওপর বাড়তি নজরদারি এবং বিদেশী কর্মীদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা এবং আবাসনের উন্নত সুবিধা।

আগে অনেক কর্মী শোষণমূলক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতেন, যেখানে প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ খুবই সীমিত ছিল। তবে আরও কঠোর শর্তাবলি কিছু ক্ষেত্রে কর্মীদের জন্য প্রথমেই পারমিট পাওয়া কঠিন করে তুলেছে। ২০২২ সালে, কানাডিয়ান ফেডারেশন অব ইনডিপেন্ডেন্ট বিজনেস জানিয়েছিল যে, ৫৪% ছোট ব্যবসাকর্মী সংকটে ভুগছিল, অনেকেই দেরিতে ওয়ার্ক পারমিট প্রক্রিয়াকরণকেই প্রধান কারণ হিসেবে দায়ী করেছিল।

নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে, বিরোধী দলগুলো এই ইস্যুকে সামনে নিয়ে এসেছে, সরকারকে গ্রামীণ এবং উপশহরীয় ব্যবসার প্রয়োজনীয়তা উপেক্ষা করার অভিযোগ তুলেছে। তবে কানাডার নাগরিকরা সরকারের এই কঠোর নীতিকে সমর্থন করছে এবং ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ট্রুডো তার আগের অভিবাসনবান্ধব যে ইমেজ ছিল, সেটি যে মুছে ফেলছেন, সেটি তাকে অন্তত কানাডিয়ান নাগরিকদের কাছে আগামী নির্বাচনে কিছুটা হলেও গ্রহণযোগ্য করে তুলবে বলে মনে হচ্ছে।

এই পরিবর্তনগুলোর প্রতি জনসাধারণের প্রতিক্রিয়ায় ভিন্নতা রয়েছে। কানাডিয়ানদের মধ্যে বিশেষ করে বড় শহরাঞ্চলে, একটি ক্রমবর্ধমান স্বীকৃতি রয়েছে যে, যদিও অভিবাসন এবং আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সুবিধা নিয়ে আসে, তারা আবাসনের খরচ এবং চাকরির প্রতিযোগিতাও বৃদ্ধি করে ।

২০২২ সালে অ্যাঙ্গাস রেইড ইনস্টিটিউটের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, ৪৯% কানাডিয়ানরা বিশ্বাস করেন যে, অভিবাসনের মাত্রা কমানো উচিত, আবাসন ব্যয় এবং অতিরিক্ত চাপযুক্ত পাবলিক পরিষেবা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। অন্যদিকে, অনেক কানাডিয়ান, বিশেষ করে অভিবাসন সমৃদ্ধ এলাকাগুলোতে, উচ্চ অভিবাসন স্তরের পক্ষে রয়েছেন।

কারণ, তারা স্বীকার করেন যে, নতুনরা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বজায় রাখা এবং জনমিতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অপরিহার্য। ট্রুডোর অভিবাসননীতি সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি নিঃসন্দেহে পরিবর্তিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার প্রথম বছরগুলোতে তাকে উন্মুক্ত সীমানা এবং প্রগতিশীল অভিবাসননীতির চ্যাম্পিয়ন হিসেবে দেখা হয়েছিল। তবে, একটি দেশ পরিচালনার বাস্তবতা, যা অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি এবং ক্রমবর্ধমান জনসমাজবাদী মনোভাবের বৃদ্ধি পেয়েছে।
তাকে আরও বাস্তববাদী এবং মাঝে মাঝে কঠোর অভিবাসন ব্যবস্থা গ্রহণে প্ররোচিত করেছে। তার সরকারের সাম্প্রতিক ভিসা পরিবর্তনগুলো সিস্টেমের অখ-তা রক্ষার প্রচেষ্টা হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে, তবে এটি পরবর্তী ফেডারেল নির্বাচনকে সামনে রেখে আরও সতর্কপন্থার প্রতিফলনও।

ট্রুডোর সমর্থকরা দাবি করেন যে, এই সংস্কারগুলো প্রবৃদ্ধি এবং স্থায়িত্বের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে প্রয়োজনী। অন্যদিকে তার সমালোচকরা, উভয় ডান ও বাম থেকে অভিযোগ করেন যে, তিনি হয় যথেষ্ট পদক্ষেপ নেননি বা কানাডার অন্তর্ভুক্তিমূলক মূল্যবোধের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন।

ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে ২০২৫ সালের নির্বাচনের সময় কানাডার অভিবাসননীতি নিয়ে বিতর্ক আরও তীব্র হতে পারে। অভিবাসন সবসময়ই কানাডিয়ান রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ছিল। তবে এটি ক্রমবর্ধমানভাবে মেরুকৃত হয়ে উঠছে। নির্বাচনটির ফলাফল অনেকটাই নির্ভর করতে পারে দলগুলো এই ইস্যুতে নিজেদের কীভাবে অবস্থান করছে তার উপর।

বিশেষত বর্তমানে কানাডা একটি অনিশ্চিত অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ, জনমিতিক পরিবর্তন এবং প্রতিভা অর্জনে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার মুখোমুখি। তাছাড়া প্রায় একযুগ ক্ষমতায় থাকার পরে ট্রুডো সরকারের জনপ্রিয়তায়ও ভাটা পড়েছে। এটি সত্য যে, গত এক দশকে কানাডা উন্নত দেশগুলোর মধ্যে নানা সূচকে পিছিয়ে পড়েছে এবং বেশিরভাগ কানাডিয়ান মনে করছেন ট্রুডো সরকারের শাসনামল দেশকে এই পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়েছে।

নিজের দেশের ও জনগণের দিকে না মনোযোগ দিয়ে ট্রুডো অভিবাসী, শরণার্থী, ও আমেরিকার যুদ্ধে নিজেদের অর্থসম্পদ ব্যয় করে নিজের মানুষকে বঞ্চিত করেছেন। সত্য বলতে কি ট্রুডোর জনপ্রিয়তা এতটাই কমে গেছে যে, আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী, অভিবাসী, শর্র্র্র্র্রণার্থীদের অন্তর্ভুক্তিতে রাশ টেনে ধরতে না পারলে, দ্রব্যমূল্য ও আবাসনের খরচ না কমাতে পারলে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে না পারলে ২০২৫ সালের ফেডারেল নির্বাচনে লেবারেল সরকারের জিতে আসার সম্ভাবনা খুবই কম।

Leave a comment






এই বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

shuddhobarta24
Privacy Overview

This website uses cookies so that we can provide you with the best user experience possible. Cookie information is stored in your browser and performs functions such as recognising you when you return to our website and helping our team to understand which sections of the website you find most interesting and useful.