Home » আমানত নিয়ে নতুন শঙ্কা

আমানত নিয়ে নতুন শঙ্কা

অনলাইন ডেস্ক: সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করা এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। আবার ফেরত পাওয়ার অনিশ্চয়তার কারণে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানে টাকা রাখতে চাইছেন না অনেকে। শেয়ারবাজারের টালমাটাল অবস্থার কারণে সেখানেও আস্থা নেই বিনিয়োগকারীদের। এর মধ্যে ব্যাংক আমানতে সুদহারের সর্বোচ্চ সীমা ৬ শতাংশে বেঁধে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে- আমানতকারীদের কী হবে? টাকা তারা রাখবেন কোথায়? আমানত নিয়ে নতুন এই অনিশ্চয়তার মধ্যে কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, উচ্চ সুদের প্রলোভন দেখিয়ে গজিয়ে উঠতে পারে নানা ‘হায় হায়’ প্রতিষ্ঠান। সঞ্চয়কারীকে নিঃস্ব করে যে কোনো সময় আবার হাওয়া হয়ে যেতে পারে তারা।

অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, আমানতের সুদহার ৬ শতাংশ নির্ধারণ করা হলে অভ্যন্তরীণ সঞ্চয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ফলে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে। অপ্রচলিত খাতে চলে যাওয়ার পাশাপাশি অর্থ পাচার আরও বাড়বে। এতে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হয়ে অর্থনীতি আরও ধীর হয়ে পড়বে। কেননা, বিনিয়োগের বড় অংশ আসে সঞ্চয় থেকে। এরই মধ্যে সরকারি আমানতে সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ সুদহারের সীমা বেঁধে দিয়েছে সরকার। আগামী এপ্রিল থেকে অন্য আমানতেও এ সীমা কার্যকর হওয়ার কথা। সব ক্ষেত্রে এটি কার্যকর হলে আমানতকারীরা ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিয়ে বেশি মুনাফার আশায় যেনতেন প্রতিষ্ঠানে রাখতে পারেন। জনগণের আমানত অপ্রচলিত খাতে চলে গেলে ব্যাংকে তারল্য সংকট আরও বাড়তে পারে। ফলে নতুন করে ডেসটিনি, ইউনিপে, ইউনিরুট, আজিজ কো-অপারেটিভ, যুবকের মতো অনেক ধান্দাবাজ প্রতিষ্ঠান গজিয়ে উঠবে। ফলে ঋণের সুদ কমানোর লক্ষ্যে শুধু আমানতের সুদ কমানোর ওপর জোর না দিয়ে খেলাপি ঋণ আদায়, বাহুল্য খরচ কমানোর পাশাপাশি উচ্চ মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা থেকে ব্যাংকগুলোকে সরে আসার পরামর্শ দিয়েছেন বিশিষ্টজন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেন, প্রবৃদ্ধির হার ৮ শতাংশের বেশি অর্জন করতে হলে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে জিডিপির কমপক্ষে ৩৪ শতাংশ। আর বিনিয়োগের বড় একটি অংশ আসে অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় থেকে। ফলে আমানতের সুদ ৬ শতাংশ কার্যকর হলে সঞ্চয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এতে বিনিয়োগ ব্যাহত হবে। সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে। তিনি বলেন, বিনিয়োগ বাড়াতে হলে ঋণের সুদ কমাতে হবে। এ জন্য আমানতের সুদ কমালেই হবে না; বরং উচ্চ খেলাপি ঋণ ও বাহুল্য খরচ কমাতে হবে। এ ছাড়া ব্যাংকগুলোকে বেশি মুনাফা করার টার্গেট দেওয়া হয়। এ প্রবণতা রোধ করতে হবে। সীমিত মুনাফার লক্ষ্য নিয়ে এগোতে হবে। এসব পদক্ষেপ নিলে ঋণ ও আমানতের মধ্যে সুদহারের ব্যবধান (স্প্রেড) কমবে। তাতে ঋণগ্রহীতা ও আমানতকারী উভয়েই উপকৃত হবেন।

অভিজ্ঞ ব্যাংকার মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিস এ খান সমকালকে বলেন, সুদহারের বিষয়টি বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত। বাজারে সরবরাহ বাড়লে এমনিতেই সুদহার কমবে। এটা জোর করে হয় না। কেনিয়া নিয়ন্ত্রিত সুদহারের চেষ্টা করেছিল। তবে তিন বছর পর তারা আবার বাজারের ওপর ছেড়ে দিয়েছে। তাদের থেকে আমাদের শেখা উচিত যে, এটা ভালো নয়। তিনি বলেন, দেশে বেসরকারি খাতের জন্য কোনো পেনশন পদ্ধতি বা বয়স্ক ভাতা নেই। কষ্টার্জিত গ্র্যাচুইটি বা প্রভিডেন্ড ফান্ডের টাকা ব্যাংকে রেখে সেই মুনাফা দিয়ে বহু মানুষ জীবিকা নির্বাহ করেন। সুদহার কমে গেলে যে টাকা পাবেন, তাতে অবসরপ্রাপ্তদের জীবনযাপন আরও কষ্টসাধ্য হবে। এ ছাড়া এমনিতেই এখন সরকারের ঋণ বাড়ছে, সঞ্চয়পত্রের ঋণ কমছে। এ পর্যায়ে যদি সঞ্চয় কমে, তাতে বেসরকারি খাতের ঋণ আরও কমবে, যা বিনিয়োগের জন্য ভালো নয়।

আমানতকারীদের ওপর যত খÿ : বর্তমানে সরকারের নীতি আমানতকারীদের সহায়ক নয়। মূল্যস্ম্ফীতির অভিঘাত, ব্যাংকে মেয়াদি আমানতে কম সুদহার, মুনাফায় উচ্চ হারে উৎসে কর কর্তন, অ্যাকাউন্টে টাকা জমার ওপর আবগারি শুল্ক্ক, ব্যাংকের রক্ষণাবেক্ষণ চার্জ আরোপ করে সঞ্চয়কে নিরুৎসাহিত করা হয়। আবার কয়েক বছর ধরে শেয়ারবাজারের অবস্থাও ভালো নয়। শেয়ারবাজার ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় অনেকেই এখানে বিনিয়োগ করতে চান না। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত নভেম্বর মাস পর্যন্ত ব্যাংক খাতে মোট আমানত রয়েছে ১১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ১০ লাখ ৬ হাজার কোটি মেয়াদি আমানত। মাত্র ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা রয়েছে চলতি হিসাবে। ব্যাংক খাতের মোট আমানতের সিংহভাগ বেসরকারি খাতের। এ ছাড়া বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি ও বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের রয়েছে উদ্ৃব্দত্ত অর্থ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, গত নভেম্বরে আমানতের গড় সুদহার রয়েছে ৫ দশমিক ৭১ শতাংশে। চলতি আমানত এবং তিন মাস, ছয় মাস, এক বছর, দুই বছর ও তিন বছর মেয়াদি আমানতসহ গড় সুদহার এ রকম দাঁড়িয়েছে। আগামী এপ্রিল থেকে মেয়াদি আমানতে সর্বোচ্চ সুদহার ৬ শতাংশ করার ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এটি হলে তখন তিন বছর মেয়াদি আমানতে ৬ শতাংশ সুদ পেলেও অন্য ক্ষেত্রে পাবেন এর চেয়ে কম। তার মানে, তখন গড় সুদহার অনেক নিচে নেমে আসবে।

আমানতের ক্ষয় : বিশ্বের অনেক দেশে টাকা রেখে দুই-আড়াই শতাংশ বা তার চেয়ে কম সুদ পাওয়ার নজির আছে। তবে ওইসব দেশে মূল্যস্ম্ফীতি খুব কম থাকায় এবং বিনিয়োগ করার মতো নির্ভরযোগ্য অনেক উপায় থাকায় সেখানে সঞ্চয়কারীদের ঠকতে হয় না। তবে বাংলাদেশে প্রায় ৬ শতাংশ মূল্যস্ম্ফীতি রয়েছে। আমানতেও এ রকম সুদ পাওয়ার মানে, তিনি আসলে যে টাকা রাখবেন তা থেকে ক্ষয় হবে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গত ডিসেম্বরে গড় মূল্যস্ম্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এখন ধরা যাক, আমেনা বেগম এক লাখ টাকার মেয়াদি আমানত রাখলেন। ৬ শতাংশ হারে বছর শেষে তিনি পেলেন এক লাখ ৬ হাজার টাকা। তবে মূল্যস্ম্ফীতির কারণে এখন এক লাখ টাকায় যে পণ্য কিনতে পারছেন, এক বছর পরে তা কিনতে খরচ করতে হবে এক লাখ ৫ হাজার ৭৫০ টাকা। এর মানে, নিট তিনি পেলেন এক লাখ আড়াইশ’ টাকা। তবে টিআইএন না থাকার কারণে পুরো ৬ হাজার টাকা মুনাফার ওপর তাকে উৎসে কর দিতে হবে ৬শ’ টাকা। এর ওপর বছরে দুই দফায় চারশ’ টাকা চার্জ নেবে ব্যাংক। এর মানে, এক লাখ টাকা রেখে বছর শেষে তিনি আসলে পাচ্ছেন ৯৯ হাজার ২৫০ টাকা। এ নিয়ে নানা বিতর্ক থাকলেও আগামী এপ্রিল থেকে মেয়াদি আমানতে সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ সুদহারের সীমা বেঁধে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। বর্তমানে মেয়াদি আমানতে ১০ শতাংশের বেশি সুদ দিচ্ছে অধিকাংশ ব্যাংক। আমানতে এত কম সুদ পেলে সঞ্চয়কারীরা ব্যাংকে টাকা রাখতে চাইবেন কিনা- তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে সংশ্নিষ্টদের।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিআরআইএর নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর সমকালকে বলেন, আমানতের সুদহার ৬ শতাংশ বেঁধে দেওয়া ঠিক হবে না। এটা করলে মানুষ টাকা ব্যাংকে রাখতে চাইবেন না। তিনি বলেন, রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, যারা সঞ্চয় করেন তারা যে শুধু সঞ্চয় দেশে রাখবেন, তা নয়। বিদেশেও সঞ্চয় করতে পারেন। কাজেই আমাদের আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গেও প্রতিযোগিতা করতে হবে। তা না হলে দেশ থেকে টাকা পাচার বেড়ে যাবে। এ জন্য সঞ্চয়কে আকর্ষণীয় করতে হবে। তার মতে, ব্যাংক খাতে ঋণের সুদহার ৯ এবং আমানতের সুদহার ৬ শতাংশ নির্ধারণ করা হলে আমানত কমে যাবে। তারল্য সংকট সৃষ্টি হবে। কমে যাবে ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা। ছোট ঋণগ্রহীতারা ঋণ পাবেন না। এর কারণ ব্যাখ্যা করে আইএমএফের সাবেক এ কর্মকর্তা বলেন, ছোট ঋণগ্রহীতাদের ঝুঁকি বেশি। সে জন্য সব সময় উচ্চ হারেই ঋণ নিয়ে থাকেন। ব্যাংক তাদের সহজে ঋণ দিতে চায় না। ফলে তাদের কাছে ঋণ পাওয়াটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য তারা চড়া সুদেই ঋণ নেন। ৯ শতাংশ সুদে কোনো ব্যাংক থেকে তখন আর ঋণ পাবেন না তারা। শুধু বড় ঋণগ্রহীতাই এই সুবিধা পাবেন বলে মনে করেন তিনি।

সঞ্চয় হার তেমন বাড়ছে না : দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে জনগণের ভোগ ব্যয়ও বেড়ে গেছে। ফলে জিডিপিতে জাতীয় সঞ্চয়ের হার কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বাড়ছে না। কয়েক বছর ধরে তা ২৮ থেকে ৩০ শতাংশের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। বেসরকারি বিনিয়োগের গতিও মন্থর। অর্থনীতিবিদরা বলেন, কয়েক বছর ধরে যে গতিতে জাতীয় আয় ও মাথাপিছু আয় বেড়েছে, সেই হারে সঞ্চয় ও বিনিয়োগ বাড়েনি। এর অর্থ হচ্ছে, আয়ের বড় অংশই চলে যাচ্ছে ভোগ ব্যয়ে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় কাঙ্ক্ষিত হারে বৃদ্ধি না পাওয়ায় বেসরকারি বিনিয়োগ স্থবির হয়ে আছে। ফলে নতুন শিল্প যেমন গড়ে উঠছে না, তেমনি কর্মসংস্থানও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *