দুটি ঘটনা তো খুব বেশি স্মৃতি না হাতড়েই মনে করা যায়। একটি ২৩ বছর পুরোনো, অন্যটির বয়স বছর এগারো হলো।
২০০২ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে ৩ উইকেটে ৮০ থেকে বাংলাদেশ মাত্র ৩১ বলের মধ্যে ৮৭ রানেই অলআউট হয়ে গিয়েছিল। প্রথম ইনিংসে ৩৯৭ রানের লিড নেওয়া ওয়েস্ট ইন্ডিজ তিন দিনের মধ্যে সব হিসেব চুকিয়ে বাকি দুদিন বিশ্রামের সুযোগ তৈরি করে নিয়েছিল।
২০১৪ সালের ঘটনাটাও মিরপুরেই। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে ২০০২ সালের ম্যাচটিতে না হয় বাংলাদেশকে নিয়ে তেমন আশা ছিল না, কিন্তু ১১ বছর আগে ভারতের সঙ্গে ওয়ানডেতে বাংলাদেশের ধসের স্মৃতি তো আরও বিভীষিকাময়! সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে অভিষেকেই পাঁচ উইকেট নেওয়া তাসকিন আহমেদের গতিতে ভারতকে মাত্র ১০৫ রানেই অলআউট করে দিয়েছিল বাংলাদেশ। নিশ্চিত জয় ধরে নিয়ে বাংলাদেশের ইনিংস যাঁরা দেখতে বসেছিলেন, তাঁরা ‘হরর স্টোরি’ দেখলেন। ৩ উইকেটে ৫০ থেকে মাত্র ২৬ বলের মধ্যে বাংলাদেশের ইনিংস শেষ, অলআউট হয়ে গেল ৫৮ রানে! তা-ও ভারতের কোন বোলার বেশি ভোগালেন? সব মিলিয়ে ১৪ ম্যাচের ক্যারিয়ারে ২০ উইকেট নেওয়া মিডিয়াম পেসার স্টুয়ার্ট বিনি! ওয়ানডে ক্যারিয়ারে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ উইকেটই সেদিন নিয়েছেন বিনি (৪ রানে ৬ উইকেট)!
এতটা বাজেভাবে না হলেও পথ হারানোর এমন উদাহরণ বাংলাদেশের ক্রিকেটে আরও আছে। কলম্বোতে আজ পথ হারানোর সেই চেনা রাস্তায়ই হেঁটেছেন মেহেদি হাসান মিরাজের দল। এবার ধসটা ইনিংসের মাঝে। শ্রীলঙ্কার ২৪৪ রানের জবাবে তানজিদ হাসান তামিমের ফিফটিতে ১ উইকেটেই ১০০ রান করে ফেলেছিল বাংলাদেশ। এরপর? ১০০ ছোঁয়ার ক্ষণেই রানআউটে নাজমুল হোসেন শান্তর বিদায় দেখা বাংলাদেশ ২৬ বলের মধ্যে হারাল আরও ৬ উইকেট, এর মধ্যে স্কোরবোর্ডে যোগ হওয়া রানের সংখ্যা – ৫।
এরপর আর এই ম্যাচের বাকি থাকে কী! কখন বাংলাদেশ অলআউট হবে, আর কত রানের ব্যবধানে জিতবে শ্রীলঙ্কা, এই তো! জাকের আলী অনিকের এক প্রান্তের লড়াই ব্যবধানটাই যা কমাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত ৪ চার ৪ ছক্কায় ৫১ রান করে জাকের আউট হলেন শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে, বাংলাদেশের ইনিংস শেষ ১৬৭ রানে। বাংলাদেশের ৭৭ রানে হারের বিশ্লেষণে ‘কোত্থেকে কী হয়ে গেল’ প্রশ্নের উত্তরের খোঁজই চলবে আর কী!
শ্রীলঙ্কা ২৪৪ রান করার পর দুই দলের জয়ের সম্ভাবনায় নিক্তিটা বাংলাদেশের দিকেই কিছুটা হেলে ছিল। এই পিচে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করা সহজ নয়, তবে শ্রীলঙ্কা ২৭০-২৮০ রান তুলতে পারলে তারাই সম্ভাবনায় এগিয়ে থাকত বলে মনে করছিলেন অনেকে। বাংলাদেশ জবাবটাও ভালোই দিচ্ছিল। পারভেজ হোসেন ইমন (১৩) পঞ্চম ওভারে ফিরলেও দ্বিতীয় উইকেটে ৭১ রানের জুটির পথে তানজিদ তামিমকে দারুণ সঙ্গ দিচ্ছিলেন নাজমুল হোসেন শান্ত। শুরু থেকেই আক্রমণাত্মক তানজিদ তামিম ৫১ বলে ৮ চার ১ ছক্কায় ফিফটিও পূরণ করে ফেলেন।
কিন্তু দলের রান যখন ৯৯ থেকে ১০০ হচ্ছে, একটা ভুল হয়ে গেল। কে জানত, সেটিই শেষ পর্যন্ত ধসের শুরু ঘোষণা করে দেবে! সিঙ্গেল নেওয়া যেত, দুই রান নিলে ঝুঁকি থাকে – এমন জায়গায় বল ফেলেই দুই রানের জন্য কল দিলেন শান্ত। দৌড়ালেনও। কিন্তু হলো না। রানআউট হয়ে গেলেন শান্ত। বাংলাদেশের স্কোর ১০০-ও হলো, আবার উইকেটও ১ থেকে ২ হয়ে গেল।
ব্যস, এরপর রানের ঘরের চেয়ে দ্রুতগতিতে এগোতে থাকল উইকেটের ঘরের সংখ্যা! লিটন দাস এসেই হাসারাঙ্গার গুগলিতে পরাস্ত, আম্পায়ার এলবিডাব্লিউ না দিলেও রিভিউতে নিশ্চিত হলো – ডাক নিয়ে বিদায় নিচ্ছেন লিটন। সেই ওভারেই তিন বল পর আরও বড় ধাক্কা! ৬১ বলে ৬২ রান করা তামিম ফিরলেন লিয়ানাগের দুর্দান্ত ক্যাচের শিকার হয়ে!
এ পর্যন্ত তবু কারও মনে হতেই পারে, এমন তো হতেই পারে। কিন্তু এরপর যা হলো, সেটার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিলেন না। হৃদয়ের ব্যাট আর প্যাডের মাঝ দিয়ে কামিন্দু মেন্ডিসের বলটা ‘চিচিংফাক’ বলে ঢুকে গেল, লিটনের মতোই ডাক নিয়ে ফিরলেন হৃদয়। ওয়ানডেতে অধিনায়কত্বের পূর্ণকালীন দায়িত্বের অভিষেকে বল হাতে উইকেট না পাওয়া মিরাজও একই পথের পথিক – রানের হিসাবেও শূন্য। হাসারাঙ্গার আরেকটি গুগলিতে রিভিউ নিয়েও বাঁচতে পারেননি।
তানজিম হাসান সাকিব আউট হলেন মেন্ডিসের বলে তিকসানার আরেক চোখধাঁধানো ক্যাচের শিকার হয়ে। তাসকিন সেই ওভারেই তিন বল পর এলবিডাব্লিউ! শান্ত আউট হওয়ার সময় ১৬.৩ ওভারে ১০০/২ দেখা বাংলাদেশ চোখের পলকে – ২০.৫ ওভারে ১০৫/৮!
সেখান থেকে জাকের আলীর ‘হারের ব্যবধান কমানো’ ইনিংসের শুরু। মাঝে দলকে ১২৫ রানে রেখে নবম ব্যাটসম্যান তানভীর (৫) আউট হলেন। এরপর মোস্তাফিজকে এক প্রান্তে ওভারপ্রতি এক-দুই বল দিয়ে জাকেরই যা খেললেন। যা খেললেন বলতে, নিজের ফিফটি আর বাংলাদেশের ১৫০ পার করাতে পেরেছেন আর কী! ৩৬তম ওভারে তাঁর লড়াইও শেষ হলো, বাংলাদেশের আশা-ভরসাহীন ইনিংসেরও হলো সমাপ্তি।
বার্তা বিভাগ প্রধান