Main Menu

নিদারুণ সময়ের বিহ্বলতায়

এসপি স্যারের টেবিলের সামনে মেয়েটিকে বসা দেখে একটা শীতল ভয়ের স্রোত শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে যায় নিচের দিকে। হাঁটু কাঁপতে থাকে, কান-মাথা শোঁ শোঁ করতে করতে উত্তপ্ত ধোঁয়া ছেড়ে আচ্ছন্ন করে দিতে থাকে অস্তিত্ব। মেয়েটিকে দেখে এসআই নূরুল হাবিব নিশ্চিত হয় যে, গুরুতর কারণ বলেই এসপি স্যার এত রাতে তাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। এবার বুঝি চাকরিটা নিয়েই টান পড়ে। মুহূর্তে পরস্পর বিপরীতমুখী দু’টি ভাবনা তাকে আরো বিপন্নতায় ডুবিয়ে দেয়। প্রথমত যা হয়েছে তা দু’জনের সম্মতিতেই যে হয়েছে, আর দ্বিতীয়ত যদি মেয়েটা অভিযোগ করেই থাকে তবে ব্যাপারটা যে একতরফা নয় সে প্রমাণ সে করবে কী করে? ভয় আর উপায়হীন দুশ্চিন্তার ছাপ দ্রুত তার চোখমুখ গ্রাস করে নেয়। তার জিহ্বা ভার হয়ে আসে, মনে হয় আর কোনোদিন কথাই বলতে পারবে না। ঠিক সেই মুহূর্তে এসপি স্যার মেয়েটিকে ইশারা দেন, ঠিক আছে আপনি আসুন। টেবিলে লাল চা খাওয়া শূন্য কাপ-পিরিচ ঠেলে সরিয়ে রেখে মেয়েটি উঠে নূরুল হাবীবের দিকে তীব্র দৃষ্টি ছুঁড়ে বেরিয়ে যায়। নূরুল হাবীবের মনে হয়, এখন যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে সে, তার চেয়ে বোধ হয় অ্যাকসিডেন্ট করে অপঘাতে মরে যাওয়া শ্রেয় ছিলো।

উৎসব শেষ হয়ে যাওয়ার পর যে আবশ্যিক নীরবতা নামে, তাতে লেগে থাকে কাঙ্ক্ষিত বিষণ্ণতা। ভাদ্রের ঘামঝরা উত্তাপের মতো যে আয়োজনের উন্মাদনা, তার শেষে কার্তিকের হিম নামার আগে আশ্বিনের ঝিমমারা বাতাস। সঙ্গে আবশ্যিক কিছুটা ক্লান্তি। আয়োজনের সাফল্যের উত্তাপের সঙ্গে শেষ হয়ে যাওয়ার শীতলতা। ঘরময় সব রয়েছে। উজ্জ্বল আলো, ঝুলে থাকা রঙিন বেলুন। কিন্তু উৎসব শুরুর আগের ঔজ্জ্বল্যটুকু কেমন উৎসব শেষের পর জাদুর মতো উধাও! আমন্ত্রিত অতিথিরা সব বিদায় নিয়েছে একে একে। তাদের রেখে যাওয়া উচ্ছিষ্ট প্লেটের মতই উজ্জ্বল আলোর নিচেও থ মারা উচ্ছিষ্ট নীরবতা!

সাজ পোশাক পাল্টাতে পাল্টাতে নূরুল হাবীব সামনে অপেক্ষা করে থাকা বাকি রাতটার কথা ভাবে। বিয়ের একযুগে রুমেলার গায়ে থলথলে চর্বি। আকর্ষণহীন বুক পেট প্রায় সমান। এক যুগ আগেও যখন কলেজে যাওয়ার জন্য রিকশায় চড়তো, তার শরীরের বাঁকে যে ঢেউ খেলতো, পাড়ার মোড়ে হোন্ডা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নূরুল হাবীবের মনে হতো—সে ঢেউয়ে সাঁতার না কাটলে জীবনই বৃথা। রুমেলার পলক ফেলা চোখের ইশারায়, নির্দিষ্ট মাপের বুক থেকে নেমে যাওয়া পেট, কূল থেকে নদীতে নেমে যাওয়ার আহবান রাতে ঘুমাতে দিতো না নূরুল হাবীবকে। এখন তার আকর্ষণহীন বুক পেটের দিকে তাকিয়ে মাঝে মাঝে নুরুল হাবীব অতীতের নূরুল হাবীবকে খোঁজে। বারো বছর আগে এই মেয়ের জন্য দেয়াল টপকে জানালার ফাঁক গলিয়ে একটু দেখা, একটু স্পর্শের জন্য পাগল হয়ে যেত। ধরা পড়ে তার ভাইদের হাতে মার খেতো। আকর্ষণটি কোথায় ছিল ঠিক? ঐ বুক-পেটে, নিপূন সাজিয়ে রাখা চোখজোড়ায়, নাকি এখন কলাগাছের গোড়ার মতো স্ফীত হয়ে ওঠা বাহুদ্বয়ে?—যেখানে প্রথম সে ঠোঁট ছুঁয়েছিল, সে জানালার শিক গলে!

এখন কপোলে জমে ওঠা মেছতার ছোপ, পান খেয়ে রক্তখেকো ড্রাকুলার মত বীভৎস লাল হয়ে ওঠা জিহ্বা, দাঁত, স্ফীত তলপেট দেখে সে নিজেকে খুঁজে পায়না যে, আসলে ঠিক কিসের জন্য এমন উন্মাদ হয়েছিল সে!

এসআই নূরুল হাবীব বিয়ের যুগপূর্তি উপলক্ষে স্ত্রী রুমেলাকে কোটি টাকার ফ্ল্যাট উপহার দিয়েছে। আনন্দে আর অহংকারে ডগমগ করছে রুমেলা। সকাল থেকেই শুরু হয়েছে ন্যাকা ন্যাকা গলায় ফোন। কুশলাদি জিজ্ঞাসার অভিনয়ের ফাঁকে ফ্ল্যাটের বিস্তারিত জানানো…ফিটিংস সব বাইরের ভাবি, ইন্টিরিয়র পুরো সেগুন কাঠের আপা, সন্ধ্যায় মিস কইরেন না ভাবি। 

সব ভালো করে শোনেও না নূরুল হাবীব। শোনার আগ্রহও বোধ করে না। তার এ ফ্ল্যাট কেনা যতোটা না স্ত্রী রুমেলাকে খুশি করার জন্য, তার চেয়ে অধিক স্ট্যাটাস সিম্বল। সহকর্মী সবাইকে একহাত দেখিয়ে দেয়া। আর দেখানোর জন্যই এই বিশেষ দিনটাকে বেছে নেওয়া, এক ঢিলে দুই পাখি মারা। সহকর্মী সবাই অনেক আগেই ফ্ল্যাটের মালিক হয়েছে, সেদিক থেকে পরে কিনে সর্বাধুনিক ফ্ল্যাটটাই নিয়ে সবার থেকে এগিয়েই গেছে সে। এ নিয়ে এতকাল রুমেলার যে খোঁচা-টিপ্পনি-অশান্তি ছিল, আজ পার্টিতে সবার চোখ টাটানো দেখে সব তীব্র অহংকার বাষ্প হয়ে বাতাসে মিলিয়ে গেছে। অতিথি আপ্যায়নে গলায় আহ্লাদের সুর আর ধরছিল না তার। আজ রাতটা স্বামীকে উজাড় করে দেবে সে, দুপুরে ব্যস্ততার ফাঁকে নূরুল হাবীবের গায়ের ওপর ঢলে পড়ে বেখাপ্পা কিশোরী গলায় কথা দিয়েছে রুমেলা। কিন্তু এটা ভাবতেই সুখের বদলে একটা বাড়তি চাপ যুক্ত হয়েছে নূরুল হাবীবের মাথায়। এই আকর্ষণহীন মাংসপিণ্ডে কী করে উপগত হবে সে?

শারীরিকভাবে গত একবছর ধরে খুব ফুরফুরে আছে নূরুল হাবীব। মেঘ না চাইতে জলের মতো এক অতি আকর্ষণীয় নারী উদয় হয়েছে তার জীবনে। আহা! শরীর যেখানে যে মাপের থাকার কথা কোথাও কম বা বেশি নেই এক ইঞ্চি। কেমন পাকা আমের মতো গায়ের রং, দেখলেই ছিলে খেতে ইচ্ছে করে। বেশ জড়িয়ে গেছে সে মেয়েটার সাথে। একটু অদ্ভুত, কিন্তু নূরুল হাবীবের জন্য তার দরজা সবসময় খোলা। তাই বলে নূরুল হাবীব যখন তখন হানা দিয়ে নিজের ওজন কমায় না মোটেই। পোস্টের একটা ইমেজের ব্যাপার আছে। শহরের শেষ মাথায় মেয়েটার ঠিকানা—ঠিক শহরতলী যাকে বলে। যখন তখন গেলেও কারো নজরে পড়ার কথা নয়। বাণিজ্যিক নার্সারির পর নার্সারি, ঘন গাছের ঝোপ, লালিত-পালিত সব গাছের ঝাড় বিক্রির জন্য তৈরি। সে সবের ফাঁকে মেয়েটার ঘরটা বাইরে থেকে ঠিক চোখেও পড়ে না সহজে। হয়তো আড়াল করার জন্যই এভাবে এখানে বানানো। হয়তো পেশার খাতিরেই…। যদিও মেয়েটার চেহারা-ছবি পেশাটার সাথে একদমই যায় না। কিন্তু নূরুল হাবীব এসব কিছু ঘাটায় না, তাছাড়া কোন কমপ্লেন না এলে ঘাটিয়েই বা তার কী দরকার। তার উপরে নিজেই এসে জুটেছে যখন!

সেও এক আজব ঘটনা। এক লোকের শার্টের কলার ধরে টানতে টানতে একদিন সন্ধ্যায় মেয়েটি থানায় এসে হাজির। সরাসরি তার রুমে। সাজ-পোশাক, চেহারা দেখে বাইরে কনস্টেবলদের থামিয়ে মেয়েটিকে ভেতরে এসে বসতে বলতে বাধ্য হয় নূরুল হাবীব। মেয়েটি লোকটির শার্টের কলার ছেড়ে হাঁপায় দু’-এক মিনিট। নূরুল হাবীবের সামনের চেয়ারে বসে। একেবারে নূরুল হাবীবের মুখের ওপর নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে, একে হাজতে ঢোকান, ঢোকান প্লিজ। কিন্তু অভিযোগ কী? ডায়েরি করতে হবে। অভিযোগকারী হিসেবে আপনার নাম ঠিকানা লাগবে। নূরুল হাবীবের জেরার প্রাথমিক ধাক্কায় মেয়েটা একটু থমকে যায়। কিন্তু কয়েক সেকেন্ড, তারপর কেমন স্বভাবসুলভ স্মার্টনেসে সব ধমকানো ফু মেরে উড়িয়ে দিয়ে গড়বড় করে বলতে থাকে, লোকটা ধর্ষক। ধর্ষক! 

কোথায় কাকে ধর্ষণ করেছে? ভিকটিম কে, ডাক্তারি পরীক্ষা হয়েছে? সার্টিফিকেট আছে? আবারো একসাথে অনেকগুলো জেরায় মেয়েটা উত্তর দিতে মুহূর্তমাত্র ভাবে। বলে, ধর্ষণ করবে। মেয়েটার উত্তরে লোকটিসহ পুরো কক্ষে দাঁড়ানো দু’য়েকজনসহ নূরুল হাবীব নিজেও হো হো করে হেসে ওঠে। সম্মিলিত হাসিতে মেয়েটি বিব্রত হবার বদলে নতজানু হয়, প্লিজ প্লিজ…আকুতিতে গলে পড়ে মেয়েটি। পারলে সব স্মার্টনেসের দ্বিধা ঝেড়ে পায়ে ধরে। সে সুযোগ দেয়না নূরুল হাবীব। মেয়েটার আকুতির পূর্ণ মর্যাদা দিয়ে সে জানায় লোকটিকে সে নিশ্চয়ই হাজতে পুরবে। নূরুল হাবীবের আশ্বাসে এমন কোনো ফাঁকই থাকে না যে, মেয়েটি অবিশ্বাস করে। তারপর কৃতজ্ঞতা স্বরূপই কিনা কে জানে, নিজের ফোন নম্বর আর সাথে অমোঘ এক ইশারা ছুঁড়ে দিয়ে চলে যায় মেয়েটি…।

মূলত লোকটিকে হাজতে ঢোকানোর কোনোই আইনগত ভিত্তিই নেই। কোথায় কীভাবে মেয়েটি তাকে পাকড়াও করেছে লোকটির মুখে শুনে নূরুল হাবীব হাসবে, না কাঁদবে ঠিক করতে পারে না। বিশ্বাস অবিশ্বাসের মাঝে একটি সূক্ষ্ম প্রশ্নবোধক চিহ্ন মাথা তুলে রাখে। মেয়েটিকে সে টিজও করেনি। দিব্যি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছিল। হঠাৎ উদয় হয় মেয়েটি, তাকে কলার ধরে টানতে টানতে এই থানায় নিয়ে এসেছে। লোকটিকে হাজতে ঢোকানোর কোনো যৌক্তিক কারণ থাকে না বলে নূরুল হাবীব লোকটিকে ছেড়ে দেয়।

তারপর ঘটনার দুয়েকদিন পর যতোটা না মেয়েটির আচরণের কৌতূহলে, তার চেয়েও বেশি মেয়েটির আকর্ষণে শহর পেরিয়ে মেয়েটির ঠিকানার দিকে হাঁটে হাবীব। নারীদের প্রতি তার বিশেষ আকর্ষণ ঘরে, বাইরে, ডিপার্টমেন্টে সর্বজনবিদিত। অভূতপূর্ব একটা রাত কাটে তার—হাস্যে-লাস্যে-পরিতৃপ্তিতে। ব্যাপারটা তেমন সমস্যা নয়। কোন অভিযোগ না এলেই হল। বহুগামী চরিত্রে নারীসঙ্গ কম হয়নি জীবনে। তবে এই মেয়েটির সঙ্গে আর কারো তুলনা চলে না। পরপর দুয়েকটা সুখস্মৃতি নিয়ে মেয়েটিকে সে অনায়াসেই ভুলে যেতে পারতো। প্রায়ই সে যা করে। কিন্তু প্রথমত অমোঘ আকর্ষণীয় শরীরের কারণে মেয়েটিকে সে ভুলতে পারেনা। আর দ্বিতীয়ত পরবর্তী ঘটনার পরম্পরা মেয়েটিকে তার কাছে আরো জীবন্ত এবং অনিবার্য করে তোলে।

ফুলবিক্রেতা রিজভী মিয়ার দশ বছরের মেয়েটি নিখোঁজ। থানায় ডায়েরি করার তিনদিন পর মেয়েটিকে খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু জীবিত নয়, মৃত—একটা নির্মাণাধীন বাড়ির ছাদে। রোদে ততক্ষণে লাশ ফুলে উঠে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে, গায়ে পিঁপড়ার সারি। ডাক্তারি পরীক্ষার সার্টিফিকেটে পরিষ্কার উল্লেখ : হত্যার আগে মেয়েটিকে ধর্ষণ করা হয়েছে।

সদর আসনের এমপি যে গাঁয়ের, সে গাঁয়েই স্থায়ী ঠিকানা রিজভী মিয়ার। শুধু তাই নয়, নির্বাচনের সময় ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে খেয়ে না খেয়ে ক্যানভাস করেছে সে। ফলে এমপি স্বয়ং বিষয়টাকে গুরুত্ব সহকারে নেন এবং অ্যাকশনে যান। তথ্য-প্রমাণ সাপেক্ষে দিন সাতেক পর ধর্ষক হিসেবে যখন ধরা পড়ে সেই লোকটি, যাকে মেয়েটি থানায় ধরে এনেছিল তখন নূরুল হাবীব ‘থ’ মেরে যায়। ঘটনার কাকতালীয়তা কিংবা আকস্মিকতায় তার চাকুরি জীবনের সব অভিজ্ঞতা ম্লান হয়ে যায়। লোকটি ধর্ষক। ফলবিক্রেতা রিজভী মিয়ার মেয়েটি নিখোঁজের ডায়েরি হওয়ার তিনদিন পর উদ্ধার হয়েছে মৃতদেহ আর তার সাতদিন পর ধরা পড়েছে ধর্ষক। সবমিলিয়ে অতিক্রান্ত হয়েছে দশ দিন। কিন্তু মেয়েটি লোকটিকে ধরে এনেছিল প্রায় একমাস আগে। সব কেমন তালগোল পাকিয়ে যায় নূরুল হাবীবের। যাবতীয় আইনী প্রক্রিয়া শেষ করে লোকটিকে কোর্টে চালান দিতে যে কয়দিন লাগে, সে কয়দিনে ভেতরে ভেতরে এক অস্থির উত্তাপ তাড়া করে তাকে। ঘোরগ্রস্ত লাগে মাতালের মতো…।

সেদিন সন্ধ্যায় মেয়েটির ঠিকানার উদ্দেশ্যে যেতে যেতে নূরুল হাবীব আকাঙ্ক্ষিত শরীরের মোহ নাকি ঘটনার বিস্ময়, কিসে যে নিজেকে হারিয়ে ফেলে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। শহর থেকে বের হয়ে আসার পর পুরো রাস্তা কেউ দেখেছে কিনা, কখন তার রিকশা ঠিকানাটির সামনে দাঁড়িয়েছে সে টেরই পায় না। রিকশাচালকের ডাকে তার হুশ ফেরে। মেয়েটিকে ঘটনার রহস্য জিজ্ঞেস করার সকল প্রস্তুতি ছিল তার, গত কয়েকদিন সব ব্যস্ততার ভিড়ে ভেতরে ভেতরে জেরার প্রশ্ন তৈরি করেছে সে। মেয়েটার শারীরিক সান্নিধ্যে যাওয়ার অজুহাত যতোটা, তার চেয়েও বেশি বিস্ময়ের কৌতুহল। কিন্তু ঘরে ঢুকেই সব পূর্বপ্রস্তুতি ঝুরঝুরিয়ে ভেঙে পড়ে। মেয়েটার অলঙ্ঘনীয় আকর্ষণে সব গুড়ো হয়ে সোহাগে-আদরে-আহ্লাদে মিশে বিলীন হয়ে যায়। কিছুই জিজ্ঞাসা করা হয় না।

হয়তো আর জিজ্ঞাসা করার দরকারও পড়তো না। মেয়েটার আকর্ষণে সে বারবার ছুটে ছুটে যেত। পরিতৃপ্ত হয়ে নাক ডেকে ঘুমাতো বেঢপ রুমেলার পাশে।

এদিকে আইনও তার নিজস্ব গতিতেই চলছিল। ধৃত ধর্ষকের জামিনের আবেদন বারবার নাকচ হচ্ছিল।

কিন্তু দ্বিতীয়বার ঘটনাটা ঘটল। সেদিন মেয়েটি কখন কীভাবে তাকে ভুলিয়ে পাশের উপজেলায় নিয়ে গেলো সে টেরই পেল না। আচ্ছা তার হয়েছেটা কী? নিজেকেই নিজে চিমটি কাটে নূরুল হাবীব। গত রাতটা সে মেয়েটির ঘরে কাটিয়েছে, এটুকুই তার মনে আছে। রুমেলা জানে, কিংবা জানার ভান করে, নানা অপারেশানের কাজে তার প্রায়ই এমন বাইরে রাত কাটাতে হয়। কোন সন্দেহ-আপত্তি-উচ্চবাচ্য করে না। কিন্তু রাতের পর সকালবেলা এই পাশের উপজেলা পর্যন্ত আসার ঘটনাটা কিছুতেই মনে করতে পারে না সে। মেয়েটি তাকে নিয়ে দাঁড়ায় যে লোকটির সামনে, রাস্তার মোড়ে বসে পান-সুপারি বিক্রি করছে সে। হাঁটুর ওপর তোলা লুঙ্গি, গায়ে ময়লা চিটচিটে স্যান্ডো গেঞ্জি। গেঞ্জি ফুঁড়ে বেরিয়ে থাকা কলসির তলার মতো ভুঁড়ি, কুতকুতে চোখের কোনায় সাদা ময়লা। মেয়েটির আবদার, তাকে এক্ষুনি গ্রেফতার করতে হবে। সেই পুরনো অভিযোগ—লোকটি ধর্ষক। আরে কবে কোথায় কখন কাকে ধর্ষণ করেছে সে? এবারও কিছুই বলতে পারেনা মেয়েটি। আরে পাগল নাকি! যখন পরিপূর্ণ হুঁশ ফেরে নূরুল হাবীবের, দ্রুত রিকশায় উঠে বসে সে। এই মেয়েটিকে না চেনার কথা নয় কারো, তার সাথে প্রকাশ্য দিনের আলোতে পুলিশ অফিসার নূরুল হাবীবকে দেখা গেছে। বলা যায়না, কাল স্থানীয় পত্রিকায় খবর হয়ে যেতে পারে। আর মফস্বলের পত্রিকাতো এসব খবরের জন্য তীর্থের কাকের মতো ওৎ পেতে থাকে।

‘আরে পাগল নাকি’ বলে মেয়েটিকে উপেক্ষা করে চলে এলেও নূরুল হাবীব আগের ঘটনাটা ভোলেনি। বরং পুনরায় সেই একই ঘটনা ঘটে কিনা সে ভাবনায় অফিসে ঠিকঠাক মন:সংযোগ করতে পারে না। এবং যথারীতি দিন তিনেক পর পদ্মবিলের পাড় থেকে ধর্ষিত-রক্তাক্ত মেহেরুন্নেছা নামের মেয়েটির মৃতদেহ উদ্ধার হলে, সে আর প্রমাণের অপেক্ষা না করে তৎক্ষনাৎ সেই উপজেলার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ফোন করে সেই পানওয়ালার গ্রেফতার নিশ্চিত করে।

গ্রেফতারের পর সব তথ্য-প্রমাণে এই পানওয়ালাই ধর্ষক প্রমাণিত হলে সবাই দ্রুত আসামী ধরার কৃতিত্বের মূল রহস্যটা ভুলে যায়। নূরুল হাবীব কী করে ঘটনা জানলো আর আসামী ধরতে সহায়তা করলো কেউ এ নিয়ে প্রশ্ন তোলেনা, কিংবা তুলতে ভুলে যায়। ভুলতে পারেনা শুধু নূরুল হাবীব। সে যথারীতি মেয়েটির কাছে যায়। মেয়েটি কোন প্রসঙ্গ ওঠায় না। বারবার তার কৌতুহল নিবৃত্তির সকল প্রস্তুতি ভেস্তে যায়। কিছুই জিজ্ঞাসা করা হয় না।

কিন্তু আজ! আজ এতো রাতে মেয়েটি এসপি স্যার পর্যন্ত কেনো? উত্তরটা এসপি স্যার নিজেই দেয়। বলে, শোনেন, মহিলার অভিযোগ: এর আগে আরো দু’জন ধর্ষককে আপনার কাছে নিয়ে গিয়েছিল, আপনি গুরুত্ব দেননি। এবার তাই সে সরাসরি আমার কাছে এসেছে। স্যার…স্যার…উদভ্রান্তের মতো কিছুটা আদব ভুলে এসপি স্যারকে থামায় সে। মেয়েটি যে তার সাথে রাত কাটানোর জন্য অভিযোগ নিয়ে আসেনি, বিষয়টি তাকে যতটা নির্ভার করে তৃতীয়বারের মতো মেয়েটির অদ্ভুত অভিন্ন অভিযোগ নিয়ে আসার ঘটনায় সে বিভ্রান্ত বোধ করে। সে হড়বড় করে পূর্বের ঘটনাগুলো বলতে থাকে এসপি স্যারকে, বলতে বলতে ঘামতে থাকে নূরুল হাবীব। দরদর করে সে ঘাম ঘরের এসির ঠান্ডা বাতাসকে অগ্রাহ্য করে ইউনিফর্ম গলে পা বেয়ে পড়ে এবং কার্পেট তা শুষে যেতে থাকে।

এসপি নিজেও কিছুটা ঘেমে যায় বৃত্তান্ত শুনে। ঠিক এরকমই একটা অভিযোগ নিয়েই এসেছে মেয়েটি। নূরুল হাবীবতো এখনো শোনেইনি সেটা, কিন্তু মিলে গেছে বর্তমান অভিযোগটির সাথে। এবার একেবারে শহরের সম্ভ্রান্ত এক ঘরের ভেতরে। কী করে বিনা অভিযোগ, বিনা ঘটনায় সেই বাড়িতে প্রবেশ করে তারা। অথচ পূর্বের দুই দুইটি ঘটনা প্রমাণ দিচ্ছে, এমন ঘটনা অবাস্তব নয়।

দুশ্চিন্তায় পড়ে যান এসপি সাহেব। নানা ধাপের চাকুরি জীবনে নানা বৈচিত্র্যময় বীভৎস ভয়াবহ ক্রাইম মোকাবেলা করেছেন তিনি। কিন্তু এমন অদ্ভুত সমস্যায় পড়েননি কখনো। নূরুল হাবীবকে চোখ-কান খোলা রাখতে আদেশ দেন সে রাতে। আর ঠিক দু’দিনের মাথায় সেই সম্ভ্রান্ত বাড়িতে বারো বছরের মেয়েটিকে ধর্ষিত রক্তাক্ত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করার ঘণ্টা পার না হতেই মেয়েটির গৃহশিক্ষককে গ্রেফতার করে পুলিশ।

ডায়েরি, কোর্টে চালান দেওয়া ইত্যাদির দায়িত্ব অন্য অফিসারের হাতে দিয়ে এবার নূরুল হাবীব লক্ষ্য নির্দিষ্ট ও দৃঢ় করে ছোটে সেই রহস্যময়ী মেয়েটির সন্ধানে। এসপি স্যারের রুম থেকে বের হওয়ার পর থেকে আর মেয়েটিকে খুঁজে পায়না সে। শহরতলীর নার্সারির পেছনের ঘরটি তালাবদ্ধ। নার্সারির মালিককে জিজ্ঞেস করে উত্তর পায়, এতো শহর ছেড়ে চলে যাওয়া ডাঃ হাফিজউদ্দিনের চেম্বার। এখানে বসে রোগী দেখতেন তিনি। চলে যাবার পরতো এ ঘর আর খোলা হয়নি।

খটকা লাগে নুরুল হাবীবের। সে সব খুলে বলতেও পারেনা। বলতে না পারার অস্বস্তি, আর নার্সারির মালিকের দেওয়া তথ্যের আকস্মিকতা তাকে অস্থির করে। তার দমবন্ধ লাগে। গত একবছরে রাতের পর রাত কাটিয়েছে সে এ ঘরে। কীভাবে এ কথা সে এই আম পাবলিককে বলে! মেয়েটিই বা কোথায় উধাও হলো! ঘুমের মধ্যে দমবন্ধ হয়ে লাফিয়ে উঠে সে এক অজানা আতঙ্কে। না, এর রহস্য তাকে জানতেই হবে।

পুলিশী দায়িত্বের সব ভাবভঙ্গ, কাঁটাতার গুটিয়ে সে একান্তে চা-সিগারেট খেয়ে ভাব জমায় নার্সারির মালিকের সাথে। একথা সেকথায় নানা প্রসঙ্গে ডাঃ হাফিজ উদ্দিনের প্রসঙ্গ ওঠায়। কিন্তু নার্সারির মালিক চতুর লোক, কিছুতেই মুখ খোলে না। সপ্তাহ খানেক চেষ্টা করার পর, ‘অর্ধেক বাড়ি ডাঃ হাফিজউদ্দিন বিক্রি করতে পারেননি আর তিনি এখন ঢাকায় ছেলের কাছে থাকেন’ ছাড়া আর কোন খবরই উদ্ধার করতে পারে না নূরুল হাবীব।

হাল ছেড়ে দেবে যখন, তখন একদিন ধর্ষণ প্রবণ এলাকা হিসেবে গত পাঁচ বছরে ডায়েরিকৃত ধর্ষণ মামলার হিসেব চেয়ে পুলিশ সদর দফতর থেকে জরুরি মেইল পাঠায় তিন কর্মদিবসের সময় দিয়ে। দ্রুত উত্তর তৈরি করতে তথ্য উপাত্তের সন্ধানে পুরনো ফাইল ঘাটতে গিয়ে বছর পাঁচেক আগের এক এজহার হঠাৎ হাতে আসে তার। ডাঃ হাফিজউদ্দিনের করা মামলা। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেয়েটি তার শহরতলীর বাড়িতে ফেরার সময় রাস্তায় ধর্ষিত হয়েছে। সেখানেই সে আবিষ্কার করে ডাঃ হাফিজউদ্দিনের মোবাইল নম্বর। তৎক্ষণাৎ সাত রাজার ধন প্রাপ্তির মত অভূতপূর্ব আনন্দ অনুভব করে নূরুল হাবীব।

দেরি করে না নূরুল হাবীব। সাথে সাথে নম্বরটাতে ফোন দেয়। রোগী হিসেবে পরিচয় দেয় নিজেকে। পুলিশ শুনলে ডাঃ হাফিজউদ্দিন দেখা করতে নাও রাজি হতে পারেন। সাবধানের মার নেই। ফোনেই ঠিকানা জেনে পরদিনই রওনা হয় ঢাকার উদ্দেশ্যে। পরদিন তিনি যখন মোহাম্মদপুর শাহজাহান রোডে ডাঃ হাফিজউদ্দিনের সাইনবোর্ড খুঁজে পায় তখন সন্ধ্যা প্রায় অতিক্রান্ত। চেম্বারেই পাওয়া যায় তাকে। টিমটিমে আলোয় পত্রিকার পাতা ওল্টাচ্ছেন ডাঃ হাফিজউদ্দিন, গলায় একটা স্টেথোস্কোপ। সামনে-পাশে গোটাকয় চেয়ার থাকলেও রোগী নেই। নূরুল হাবীব ভনিতা না করে নিজের আসল পরিচয়টা দেয়। কিন্তু একটা মিথ্যে তাকে বলতে হয়, পাঁচ বছর আগের ধর্ষণ মামলাটি পুনঃতদন্তের দায়িত্ব পেয়েছে সে। শুনে ডাঃ হাফিজউদ্দিন দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন, বলেন, আমিতো কোন পুনঃতদন্ত চাইনি, কে আপনাকে আবার দায়িত্ব দিল, কেনো দিল! নূরুল হাবীব মিথ্যে বলতে পারে অনায়াসে। কিন্তু এবার একটু আটকে আটকে যায়। বুকের ভেতরে কোন এক অচেনা আতঙ্ক হাতুড়ি পেটায়। পুলিশের চাকরিতে কত গলা কাটা, মাথা কাটা, নাড়িভুড়ি বের করা মৃতদেহ হাতিয়েছে সে, ঘাবড়ায়নি কখনো। আজ একটা সামান্য ধর্ষণ ঘটনার কেসে এক নড়বড়ে বৃদ্ধের কাছে ঘাবড়ে যেতে থাকে ভেতরে ভেতরে। কিন্তু বুঝতে দেয় না। কণ্ঠে যথাসাধ্য আত্মবিশ্বাস সংহত করে বলে, আপনি চান না ধর্ষকের বিচার হোক, আর কোন মেয়ে ধর্ষণের শিকার না হোক? ধর্ষনের বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স, আপনি জানেন বোধহয়, এবার আপনার মেয়ের ধর্ষকের শাস্তি হবেই হবে, নিশ্চিত থাকুন।

এই উত্তেজিত ভাষণ স্থির ডাঃ হাফিজউদ্দিনকে মোটেই বিচলিত করে না। তিনি নির্বিকার। নির্মোহ কণ্ঠে বলেন, শোনেন আমার মেয়েটা নেই। কাজেই আর কোন মেয়ে নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। আপনি আসুন।

নেই মানে! হাফিজউদ্দিন পুনরায় পত্রিকাটা চোখের সামনে খুলে ঠান্ডা গলায় বলে, নেই মানে নেই। আত্মহত্যা করেছে। কেন, যারা পুনতদন্তের নির্দেশ দিয়েছে তারা জানায়নি আপনাকে? আমার মেয়েটা আমার চেম্বারের কড়িকাঠে ঝুলে গলায় দড়ি দিয়েছে!

নূরুল হাবীব চমকে উঠে দাঁড়ায়। চেম্বারের কড়িকাঠে ঝুলে? নার্সারির মালিক জানিয়েছিল ডাঃ হাফিজউদ্দিন শহর ছেড়ে যাওয়ার পর ঐ চেম্বারের দরজা আর খোলা হয়নি।

হাঁটুকাঁপা আতঙ্ক নিয়ে নূরুল হাবীব জানতে চায়, আমি আপনার মেয়ের একটা ছবি দেখতে পারি? ফ্যানের বাতাসে উড়তে থাকা পত্রিকাটিকে এক হাতে চেপে ধরে অন্য হাতে টেবিলের ড্রয়ার খোলে ডাঃ হাফিজউদ্দিন। ড্রয়ারের ভেতরে রাখা খয়েরি রঙের ডায়েরি থেকে একটা লেমিনেট করার ফটোগ্রাফ এগিয়ে দেয় নূরুল হাবীবের দিকে। নূরুল হাবীবের মনে হয় তার পায়ের নীচে মাটি প্রচণ্ড ভূমিকম্পে দ্বিখণ্ডিত হচ্ছে, আর সে তলিয়ে যাচ্ছে ঠিকানাহীন অতল গহিনে…

Leave a comment






এই বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

shuddhobarta24
Privacy Overview

This website uses cookies so that we can provide you with the best user experience possible. Cookie information is stored in your browser and performs functions such as recognising you when you return to our website and helping our team to understand which sections of the website you find most interesting and useful.