অনলাইন ডেস্ক: টেলিকম শিল্পে প্রশাসনিক দীর্ঘসূত্রতা কমিয়ে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ, ডিজিটাল নিরাপত্তা, ডেটা সুরক্ষা ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ নিশ্চিতের বিধান রেখে প্রণয়ন করা হচ্ছে ‘বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫’-এর খসড়া। এসব প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত করে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) এই অধ্যাদেশের খসড়া প্রণয়ন করে গত ১২ আগস্ট পাঠিয়েছে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগে। এর আগে প্রধান উপদেষ্টার ডাক, টেলিযোগাযোগ এবং তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব গত ২৯ জুলাই এক চিঠিতে ২০০১ সালের আইন সংশোধন পরিমার্জনের নির্দেশ দেন বিটিআরসিকে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, নতুন অধ্যাদেশ চূড়ান্ত হলে ২০১০ সালের সংশোধিত আইন বাতিল হবে, যা বিটিআরসির স্বাধীনতা ‘গুরুতরভাবে খর্ব’ করেছিল বলে কমিশনের চিঠিতে উল্লেখ আছে। নতুন প্রস্তাবে লাইসেন্স ইস্যু, নবায়ন, হস্তান্তর, স্থগিতকরণ ও বাতিলের ক্ষেত্রে সরকারের পূর্বানুমতি ছাড়াই কমিশনকে পূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
বিটিআরসির চিঠির ২নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, যেহেতু ইন্টারনেটসহ সামগ্রিক টেলিযোগাযোগ সেবা বর্তমান বিশে^ মৌলিক মানবাধিকারসম স্বীকৃত, উক্ত অধিকার যেন অযৌক্তিক বা অযাচিতভাবে খর্ব না হয়; সেজন্য মূল আইনের ধারা ৯৭-এর স্থলে নতুন ধারা ৯৭ প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে- স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষের পরামর্শে ইন্টারনেট সেবা নিয়ন্ত্রণের সুস্পষ্ট প্রক্রিয়া নির্ধারণ করা হবে।
বিটিআরসির ক্ষমতায় বড় পরিবর্তন : নতুন অধ্যাদেশে বিটিআরসির প্রয়োগিক ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে কয়েকটি মূল ক্ষেত্রে। যেমন- লাইসেন্স সম্পর্কিত পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ, নতুন লাইসেন্স অনুমোদন, নবায়ন, শেয়ার হস্তান্তর বা নাম পরিবর্তনে আর মন্ত্রণালয়ের পূর্বানুমতির বাধা থাকবে না।
বকেয়া আদায়ে কঠোরতা : প্রস্তাবিত ২৬(৩) ধারায় বলা হয়েছে- বিটিআরসি রাজস্ব ফাঁকি বা বকেয়া আদায়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করতে পারবে। টেলিযোগাযোগ সেবার মূল্য নির্ধারণে মন্ত্রণালয়ের অনুমতি কেবল নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে প্রযোজ্য হবে। তরঙ্গ ভাগাভাগি, ট্রেডিং, লিজিং ও রিফার্মের সুযোগ তৈরি করা হবে, যা অপারেটরদের খরচ কমাবে এবং সেবা সম্প্রসারণ সহজ করবে। আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে একক গেটওয়ে এজেন্সির মাধ্যমে সীমিত আড়িপাতার আইনগত কাঠামো তৈরি হবে।
বিটিআরসির আইন শাখার মহাপরিচালক আশীষ কুমার কুন্ডু স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়, ‘২০১০ সালের আইন অনাকাক্সিক্ষত দাপ্তরিক জটিলতা ও পক্ষপাতিত্বের সুযোগ তৈরি করেছিল। নতুন অধ্যাদেশের খসড়ায় স্বাধীনতা ও জবাবদিহিতার ভারসাম্য রক্ষার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।’
খসড়ায় জবাবদিহিতার দিকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ফলে, রুল অব বিজনেস ও অ্যালোকেশন অব বিজনেসের আওতায় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ও তদারকি বজায় থাকবে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি নীতি বিশেষজ্ঞ ড. মাহবুব হাসান বলেন, ‘একক কর্তৃপক্ষের হাতে অতিরিক্ত ক্ষমতা থাকলে সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতা বজায় রাখা জরুরি। না হলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা যেমন বাড়তে পারে, তেমনি ক্ষয়ও হতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘নতুন এই সংশোধনীর ফলে বিটিআরসির প্রায়োগিক ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে। বিনিয়োগকারীরা দ্রুত সিদ্ধান্তসহ কম সময়ে সেবা এবং স্পষ্টনীতি পাবে, যা খাতের প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করতে পারে। তবে এই স্বাধীনতা যেন সঠিক জবাবদিহিতার আওতায় থাকে, এটি নিশ্চিত করাই হবে সরকারের এবং বিটিআরসির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।’
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই প্রস্তাবিত পরিবর্তনগুলো বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করবে। প্রশাসনিক দীর্ঘসূত্রতা কমবে। লাইসেন্স ও নীতি অনুমোদনে দ্রুততা বিনিয়োগ সিদ্ধান্তকে গতি দেবে। বিনিয়োগকারীরা একক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কাজ করায় সিদ্ধান্তের ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে। স্পেকট্রাম ভাগাভাগি ও পরিকাঠামো লিজিং বিনিয়োগ খরচ কমাবে এবং নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ ত্বরান্বিত করবে। সেবার মানোন্নয়নে নতুন লাইসেন্স শর্তে উন্নত সেবা প্রদানে প্রণোদনা (পুরস্কার/ছাড়) থাকায় অপারেটরদের মান উন্নয়নে উৎসাহিত করবে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মোবাইল ফোন অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশনের (এমটিএসওবি) এক কর্মকর্তা বলেন, ‘যদি এই অধ্যাদেশ কার্যকর হয়, বিনিয়োগকারীরা দ্রুত অনুমোদন ও স্পষ্ট নীতি পাবে, যা বিদেশি বিনিয়োগ আনার ক্ষেত্রেও সহায়ক হবে।’
লাইসেন্সধারীদের সেবার মান আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে মূল্যায়ন হবে এবং খারাপ সেবার ক্ষেত্রে শাস্তি, ভালো সেবার ক্ষেত্রে পুরস্কার প্রথা চালু হবে।
প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা আইন, সাইবার সুরক্ষা আইন, ডেটা গভর্নেন্স অ্যান্ড ইন্টার অপারেবিলিটি আইন, ন্যাশনাল এআই পলিসিসহ একাধিক নীতি ও আইনের সঙ্গে সমন্বয়ের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, মানুষের জীবনযাত্রার জন্য অপরিহার্য- খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা এগুলো মৌলিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। তবে সংবিধান অনুযায়ী, মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো হলো আইনের আশ্রয় লাভ, জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা, চলাফেরার স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা, সংগঠনের স্বাধীনতা, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা, পেশা ও বৃত্তির স্বাধীনতা, ধর্মের স্বাধীনতা, সম্পত্তির অধিকার, এবং ব্যক্তি স্বাধীনতা ও গোপনীয়তার অধিকার।
প্রতিনিধি