Home » এক একরে হয়ে হাজার গাছের (মৃত্যুদণ্ড)

এক একরে হয়ে হাজার গাছের (মৃত্যুদণ্ড)

ডেস্ক নিউজ : এক একরে হয় এক হাজার গাছ। সাড়ে পাঁচ হাজার একরে ৫৫ লাখ। এই সরল হিসাবটা কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ বনাঞ্চলের। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে রাতারাতি উজাড় হয়ে গেছে সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার সংরক্ষিত বনভূমির গাছ। শুধু রোহিঙ্গাদের কারণেই নয়, উন্নয়নের বলিও হচ্ছে গাছগাছালি। মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল, মাতারবাড়ী মদুনাঘাট-মেঘনা ৪০০ কেভি বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন, ইস্টার্ন রিফাইনারির তেলের ডিপো নির্মাণ, রেলওয়ের দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্প এবং চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় সিটি আউটার রিং রোড নির্মাণসহ বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কাটা পড়ছে গাছ। অঙ্ক কষে দেখা গেছে, শুধু এসব কারণে চট্টগ্রাম অঞ্চলে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছে এক কোটি ৮ লাখ ২০ হাজার গাছ!

“অর্থনৈতিক অঞ্চলে ৫২ লাখ গাছ :৩০ হাজার একর ভূমিতে হচ্ছে মিরসরাই ইকোনমিক জোন। বিশাল এ অর্থনৈতিক জোনের জন্য উপকূলীয় বন বিভাগের লাগানো ছোট-বড় এবং প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো প্রায় ৫২ লাখ গাছ কাটা পড়তে যাচ্ছে। এর মধ্যে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো গাছের সংখ্যা হলো ৫০ লাখ। প্রকল্পের জন্য অ্যাপ্রোচ রোড নির্মাণ, এক হাজার ১৫০ একরে বেপজা ইকোনমিক জোন, ৫০০ একর জায়গায় বসুন্ধরা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইকোনমিক জোন এবং অনন্ত অ্যাপারেলস পার্ক স্থাপনের জন্য এসব গাছ কাটা পড়বে। কাটা পড়া গাছের মধ্যে রয়েছে গেওয়া, বাইন, কেওড়া, নোনা ঝাউ, মনকাটা, লতা, গুল্ম ইত্যাদি। প্রকল্প-সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মিরসরাই ইকোনমিক জোনের কাজ চলছে। মাটি ভরাট ও অ্যাপ্রোচ সড়ক নির্মাণের কাজ চলছে। ফলে ইতিমধ্যে প্রকল্পের জন্য বিপুল সংখ্যক গাছ কাটা পড়েছে।”

বিদ্যুৎ লাইনে ১৩ কিলোমিটার বন :বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইন স্থাপনের জন্য দীর্ঘ প্রায় ১৩ কিলোমিটার বন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মাতারবাড়ী-মদুনাঘাট-মেঘনাঘাট ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইন প্রকল্পের আওতায় চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ৬৩ হেক্টর বনভূমির ওপর দিয়ে যাবে এ বিদ্যুৎ লাইন। ফলে এই বনাঞ্চলের প্রায় ২৫ হাজার গাছ কাটা পড়বে। এর মধ্যে বন বিভাগের রয়েছে ৪১ দশমিক চার হেক্টর বনভূমি রয়েছে। বাংলাদেশ ফরেস্ট ইন্ডাস্ট্রিজ ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের (বিএফআইডিসি) রাবার বাগান রয়েছে ২১ দশমিক ৬ হেক্টর ভূমিতে। মিরসরাইয়ের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের আয়তন প্রায় ৭২ বর্গকিলোমিটার। বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের দুদিকে ২৩ মিটার করে মোট ৪৬ মিটার এলাকার গাছপালা কাটা হবে। এজন্য শুধু উত্তর বন বিভাগেই কাটা হবে কাঠ উপযোগী ২২৭টি গাছ, এক হাজার ৪৪০টি ভাঙন রোধে ব্যবহূত বল্লী গাছ, এক হাজার ৮৫৯টি চারা, ১২১টি বাঁশঝাড়ের হাজার বাঁশ। বাঁশঝাড়ের মধ্যে ৪৮টি মুলি, ৩০টি মিথিঙ্গা, ৩৯টি বাড়িওয়ালা বাঁশঝাড় এবং চারটি অন্য বাঁশঝাড় রয়েছে। এসব ঝাড়ে মোট বাঁশের সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। প্রকল্পের জন্য কাটা পড়তে যাচ্ছে সেগুন, গর্জন, চাপালিশসহ বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষও। রাবার বাগানে উৎপাদনশীল ১১ হাজার ৩৬৮টি রাবার গাছও কাটা হবে। মোট বাঁশসহ মোট ২৪ হাজার ৮৯৪টি গাছ।”

তেলের ডিপোতে হাজারো প্রাচীন বৃক্ষ :ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের (ইআরএল) ডিপোতে আমদানি করা জ্বালানি তেল পরিশোধনের জন্য কক্সবাজারের মহেশখালীতে সরবরাহ করা হবে। এজন্য ‘ইন্সটলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং উইথ ডাবল পাইপলাইন’ প্রকল্প হাতে নিয়েছে জ্বালানি মন্ত্রণালয়। প্রায় ১৯২ একর সংরক্ষিত বনভূমির গাছ কেটে ও বন সাফ করেই নির্মাণ করা হবে তেলের ডিপোটি। এ বনে রয়েছে প্রায় এক হাজার ৭০১টি প্রাচীন গাছ। চীনের এক্সিম ব্যাংকের অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন এই প্রকল্পের আওতায় তেলের ডিপো নির্মাণ করা হবে। বিদেশ থেকে আমদানি করা অপরিশোধিত জ্বালানি তেল গভীর সমুদ্রে অবস্থানরত মাদার ভেসেল থেকে মহেশখালীর ডিপোতে আনা হবে। সেখান থেকে চট্টগ্রামের অপরিশোধিত তেল আনোয়ারায় ইস্টার্ন রিফাইনারিতে নেওয়া হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে প্রায় ২৫ হাজার গাছ কাটা পড়বে। গত ১৪ মে এখন প্রকল্পটি বাস্তবায়নে গাছ কাটার অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ। অবশ্য এজন্য এক কোটি ৩৬ লাখ ৭৫ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ ধরা হয়েছে। এর বাইরে যে পরিমাণ গাছের ক্ষতি হবে, তার পাঁচ গুণ গাছ লাগানোর শর্ত দেওয়া হয়েছে। বিপিসিকে ১০ বছর এসব গাছের রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে।”

“রেললাইনের জন্য ২৭ কিলোমিটার বন :দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত যাচ্ছে রেললাইন। ১৬ হাজার কোটি টাকার এই রেললাইন প্রকল্প বাস্তবায়নেও কাটা পড়বে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের তিন সংরক্ষিত বনাঞ্চল- চুনতি অভয়ারণ্য, ফাইস্যাখালী অভয়ারণ্য এবং মেধাকচ্ছপিয়া জাতীয় উদ্যানের অনেক গাছ। তিন বনাঞ্চলের মধ্যে ২৭ কিলোমিটার পথের জন্য এসব গাছ কাটা পড়বে। এর মধ্যে চুনতি বনাঞ্চলে ১৫ দশমিক ৮ কিলোমিটার পথে কাটা পড়বে ৪৫ প্রজাতির ২৫ হাজার ৩৪১টি গাছ। ফাইস্যাখালীর ৮ কিলোমিটার পথে কাটা পড়বে ৩০ প্রজাতির ১১ হাজার ৭৮৭টি গাছ। এই বনাঞ্চলে যেসব গাছ কাটা পড়বে, তার মধ্যে গর্জনের সংখ্যাই বেশি। এছাড়া মেধাকচ্ছপিয়া জাতীয় উদ্যানের প্রায় এক কিলোমিটার পথে ১৯ প্রজাতির গাছ রয়েছে। সব মিলিয়ে এই প্রকল্পের জন্যও প্রায় ৪০ হাজার গাছ কাটা পড়বে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন এক সমীক্ষা থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে।”

“কেটে ফেলা হলো ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের রক্ষাকবচ :চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় সিটি আউটার রিং রোড নির্মাণের জন্য চট্টগ্রাম শহর রক্ষা বাঁধ এলাকায় কেটে ফেলা হয়েছে প্রায় ২০ হাজার গাছ। এসব গাছের গড় বয়স ১২ থেকে ১৩ বছর। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে মানুষের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করত গাছগুলো। একসঙ্গে এত গাছ কেটে ফেলায় সৈকতের সৌন্দর্যহানি ঘটছে। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে বাঁধ এলাকা থেকে গাছ কাটা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই বলে জানিয়েছেন সিডিএ চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম। স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, সৈকতে গাছ না থাকায় রোয়ানুর তা বে পতেঙ্গা উপকূলে এবার ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছে। শহর রক্ষা বাঁধের দুপাশ থেকে কেটে ফেলা গাছের মধ্যে অধিকাংশই ঝাউ। এ ছাড়া সেগুন, আকাশমনি, মেহগনি, শিশু, নারকেল, খেজুরগাছও কাটা পড়েছে। নগরীর পতেঙ্গা থেকে সাগরিকা পর্যন্ত চার লেনের এই সড়ক নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে এক হাজার ৭০০ কোটি টাকা।”

“রোহিঙ্গাদের হাতে বন উজাড় :রোহিঙ্গাদের আবাসস্থল, রান্নাবান্না ও ঘর নির্মাণের কাজের জন্য নির্বিচারে বন ধ্বংস হচ্ছে কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলায়।” “কক্সবাজার উত্তর ও দক্ষিণ বন বিভাগের দেওয়া হিসাব মতে, রোহিঙ্গাদের কারণে টেকনাফ ও উখিয়ায় প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার একর বনভূমি উজাড় হয়ে গেছে এবং আরও উজাড় হচ্ছে। কক্সবাজার বন বিভাগ জানিয়েছে, প্রতি একর বনে গড়ে এক হাজার করে গাছ রয়েছে। এই হিসাবে সাড়ে পাঁচ হাজার একর বনে ৫৫ লাখ গাছ ছিল। ছোট-বড় এসব গাছ এখন আর নেই। বন বিভাগের দেওয়া তথ্য বলছে, অর্থের হিসাবে উজাড় হওয়া বনাঞ্চলের ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৪০০ কোটি টাকা।”

যা বললেন বন, পরিবেশ ও প্রকৃতি বিশেষজ্ঞরা :নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন ও বনাঞ্চল উজাড়ে উদ্বিগ্ন বন, পরিবেশ ও প্রকৃতি বিশেষজ্ঞরা। এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড “এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের অধ্যাপক কামাল হোসেন বলেন, ‘একটি গাছ বড় হয়ে যে জীববৈচিত্র্য ধারণ করে তা কেটে আবার নতুন করে রোপণ করলেও ওই জীববৈচিত্র্য সহজে আর ফিরে আসবে না। উন্নয়ন প্রকল্প ও রোহিঙ্গাদের আবাসনের কারণে এত গাছের সর্বনাশ হচ্ছে যে এর ফলে পরিবেশে একটা বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। তাপমাত্রা বাড়বে, পাহাড় থেকে পলি এসে নদী ভরাট এবং শহরাঞ্চলগুলোতে জলাবদ্ধতা দেখা দিতে পারে।”

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিরুল হাসান খান বলেন,

“উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নকালে যাতে বন ও পরিবেশের ক্ষতি না হয় সেদিকে সর্বোচ্চ নজর দিতে হবে। বিশেষ করে নির্বিচারে গাছ নিধন করা হলে বনাঞ্চল থাকবে না। এতে শুধু জীববৈচিত্র্যই ধ্বংস হবে না, বন্যপ্রাণীর আবাস্থলও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”সূত্র: সমকাল

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *