Home » রায়হান হত্যা: এক সাক্ষীর আত্মহত্যা, আরেকজনকে হুমকি নেপথ্যে কী?

রায়হান হত্যা: এক সাক্ষীর আত্মহত্যা, আরেকজনকে হুমকি নেপথ্যে কী?

সিলেট মহানগর পুলিশের বন্দরবাজার ফাঁড়িতে হেফাজতে থাকা অবস্থায় রায়হান আহমদ নামে এক যুবকের হত্যা মামলার ঘটনার অন্যতম সাক্ষী চুলাই লাল ‘আত্মহত্যা’ করেছেন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত এই খবরটি নির্দ্বিধায় মেনে নিতে কষ্ট হয় যখন সংবাদের পরের লাইনেই লেখা হয়, এই মামলার আরেক সাক্ষী হাসানকে সাক্ষ্য না দিতে ‘হুমকি’ দেওয়া হচ্ছে। একজন সাক্ষীকে সাক্ষ্য না দিতে হুমকি দেওয়ার সময়ে যদি আরেকজন সাক্ষী আত্মহত্যা করেছেন বলে খবর প্রকাশিত হয়, তখন ওই আত্মহত্যার রহস্য উন্মোচন করা জরুরি। রহস্য উন্মোচিত না হলেও অন্তত এই আত্মহত্যাটি নিয়ে প্রশ্ন তোলা দরকার।

গত বছরের ১১ অক্টোবর ভোরে সিলেট শহরের আখালিয়ার এলাকার বাসিন্দা রায়হান আহমদকে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। পরে তাকে সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে তিনি সেখানে মারা যান। পরদিন তার স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নী কোতোয়ালি থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলাটির তদন্তে প্রথমে পুলিশ ছিল। পরে সে বছরের ১৩ অক্টোবর মামলাটি স্থানান্তর করা হয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) কাছে। গত ৫ মে আদালতে ১ হাজার ৯০০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। মূল অভিযুক্ত এসআই আকবরসহ যে ছয় জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হয়, তাদের মধ্যে পাঁচ জনই পুলিশ সদস্য। অভিযুক্ত পাঁচ পুলিশ সদস্য কারাগারে থাকলেও নোমান নামে একজন এখনও পলাতক।

সবশেষ গত ৫ ডিসেম্বর এই হত্যা মামলার শুনানিতে আদালতে উপস্থিত হন নিহত রায়হানের মা সালমা বেগম। সেখানে সাংবাদিকদের কাছে তিনি অভিযোগ করেন, এই মামলার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী চুনাই লাল আত্মহত্যা করেছেন। আরেক গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী হাসানকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে যাতে তিনি সাক্ষ্য না দেন। চুনাই লালের বাসা থেকে রায়হানকে ধরে নেওয়া হয়েছিল এবং ফাঁড়িতে নেওয়ার পর তাকে রাতভর নির্যাতনের সময় আর্তনাদের সাক্ষী হাসান। সুতরাং চুনাই লালের আত্মহত্যাটি প্রশ্নাতীত নয় এবং তাকে সাক্ষ্য না দিতে কারা হুমকি দিচ্ছে, সেটি জানাও তদন্তকারীদের জন্য কঠিন কোনও কাজ নয়।

মনে রাখা দরকার, নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যুর অভিযোগগুলো খুবই গুরুতর। এটি শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একজন বা দু’জন বা কয়েকজন সদস্যের ব্যক্তিগত অপরাধ এবং তাদের শাস্তি নিশ্চিত করার ইস্যু নয়। বরং এর সঙ্গে পুরো বাহিনীর ভাবমূর্তি এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রশ্ন জড়িত। রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো কীভাবে চলছে—এসব মৃত্যু, হত্যা বা নির্যাতনের ঘটনায় সেই প্রশ্নটি বারবারই ঘুরেফিরে সামনে আসে, যা রাষ্ট্রকে বিব্রত করে। সুতরাং, রাষ্ট্র বিব্রত হয়, এমন কোনও ঘটনা ঘটলে সেটি ধামাচাপা দেওয়া কিংবা অভিযোগটি মিথ্যা প্রমাণিত করা কিংবা ঘটনার সত্যতা প্রমাণের পথে বিবিধ অন্তরায় সৃষ্টির প্রচেষ্টা যে চলবে—সেটি অস্বাভাবিক নয়। সুতরাং, চুনাই লালের মৃত্যুটিও সম্ভবত স্বাভাবিক নয়। বরং এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড কিনা—সেটি অনুসন্ধানের দাবি রাখে। পুলিশি নির্যাতনে নিহত রায়হানের মা বলেন, দুই সাক্ষীরই যেখানে এমন অবস্থা, সেখানে তিনিসহ পরিবার অন্যরাও এখন আর নিরাপদ বোধ করছেন না। কারণ, আসামিরা জেলে থাকলেও পুলিশের প্রভাবশালী লোক। জেলে থাকলেও তারা নানাভাবে তাদের প্রভাব খাটাচ্ছে। তারা জেল থেকে বের হলে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে বলেও মনে করেন সালমা বেগম। সুতরাং, শুধু চুনাই লালের ‘আত্মহত্যা’র রহস্য উদ্ঘাটন এবং আরেক সাক্ষী হাসানকে ভয়ভীতি দেখানোর বিষয়টির সুষ্ঠু তদন্তই নয়, বরং নিহত রায়হানের পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *