Home » সিলেটে এক ছাদে দুই বোনের লাশ, কাটছে না ধোঁয়াশা

সিলেটে এক ছাদে দুই বোনের লাশ, কাটছে না ধোঁয়াশা

সিলেট নগরীর মজুমদারি এলাকার কোনাপাড়া ৩১ নম্বর বাসার ছাদ থেকে দুই বােনের লাশ উদ্ধার নিয়ে ধোঁয়াশা কাটছে না। প্রাথমিকভাবে এটিকে ‘আত্মহত্যা’ বলে ধারণা করা হলেও রহস্য উদঘাটনে তদন্ত চালাচ্ছে পুলিশ।

মঙ্গলবার (২১ সেপ্টেম্বর) সকালে ওই বাসার ছাদ থেকে রানী বেগম (৩৮) ও ফাতেমা বেগম (২৭) নামের আপন দুই বোনের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তারা কোনাপাড়া ৩১ নম্বর বাসার ৩১নং বাসার কলিম উল্লাহর মেয়ে।

পুলিশ জানায়, মঙ্গলবার সকাল ৬ টার দিকে আশপাশের লোকজন জানালা দিয়ে দুই বোনের লাশ বাসার ছাদের রডে ঝুলতে দেখে চিৎকার শুরু করেন। পরে পুলিশে খবর দিলে ঘটনাস্থলে গিয়ে ওড়না দিয়ে গলায় ফাঁস দেয়া অবস্থায় দুই বোনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

বিকেলে ময়নাতদন্ত শেষে লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে পুলিশ। পরে রাতে তাদের দাফন সম্পন্ন হয়।

নিহত দুই বোনের মধ্যে রানী বেগম বড় ও ফাতেমা বেগম ছোট। এর মধ্যে রানী বেগম নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা এবং ফাতেমা বেগম অনার্স-মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন। এই বাসায় তাদের মা, দুই ভাই ও তারা তিন বােন থাকতেন। এক বােন বিয়ের পর যুক্তরাজ্যে চলে যান। প্রবাসী ওই বোনের টাকায় চলতো তাদের সংসার।

স্থানীয়রা জানান, তাদের পরিবারের সব সদস্যই চাপা স্বভাবের ছিলেন। তাদের সঙ্গে আত্বীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের যােগাযােগ কম ছিল। তাছাড়া তাদের পরিবারে কলহ লেগেই থাকতো বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (উত্তর) আজবাহার আলী শেখ পিপিএম বলেন, দুই বােনের লাশ উদ্ধারের পর প্রতিবেশী ও স্বজনদের সাথে কথা বলে যেটুকু জানা গেছে, তাতে বিয়ে শাদি নিয়ে তাদের মধ্যে একটা হতাশা থাকতে পারে। তাদের অনেক বয়স হলেও বিয়ে হচ্ছিল না।

আজবাহার আলী শেখ আরও বলেন- তাছাড়া, তারা নানা কারণে অনেকটা মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন। দু’বােনের মৃত্যুর পেছনে ভূমি সংক্রান্ত কারণও থাকতে পারে। তবে, আমরা এখনই কোনো বিষয় নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। বিষয়টি নিয়ে আরও জিজ্ঞাসাবাদ ও তদন্ত প্রয়ােজন।

এদিকে, মঙ্গলবার রানী ও ফাতেমার লাশ উদ্ধারের পর তাদের ভাই শেখ রাজন বলন, বিয়ের আলাপ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে ‘রাগ ও ক্ষোভ’ থেকে এই চূড়ান্ত পথ বেছে নিতে পারেন তারা। এর মধ্যে রাণীর প্ররোচণায় ফাতেমা আত্মহত্যা করেছেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।

রানী ও ফাতেমা ঘরে দরজা লাগিয়ে শুধু ক্রাইম পেট্রলসহ বিদেশি টিভি চ্যানেলের সিরিয়ালগুলো দেখতেন- এমনটি উল্লেখ করে রাজন বলেন, ‘একটা বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল গত রোববারে। বরের বয়স একটু বেশি, পঞ্চাশ। লন্ডনি, দুই বাচ্চার বাবা। সে (রানী) বিয়েতে রাজি নয়, ঘরে ঝগড়া করছিল। আমরা তাকে বলি- বিয়ের প্রস্তাব মাত্র এসেছে, বিয়ে তো আর হয়ে যায়নি। আস্তে আস্তে কনে দেখাবো; হলে হলো, না হলে নাই।’

রাজন বলেন, ‘এ নিয়ে সে ঝগড়া করে মায়ের সাথে। বোনের সাথেও ঝগড়া করে। কালও (সোমবার) ঝগড়া করে সে চাচার বাসায় (একই এলাকায়) চলে যায়। প্রায়ই ঝগড়া হলে এভাবে চাচার বাসায় চলে যায়, সেখানে থেকে আসে। আমরা ভেবেছি, চাচার বাসা থেকে সে সকালে আসবে। এইপর্যন্ত আমাদের শেষ।’

তিনি আরও বলেন, ‘আজ (সোমবার) ভোর ৫টায় পাশের বাসা থেকে ডাকাডাকি করে বলে, আমাদের ছাদে মানুষ লটকে আছে। তখন আমরা দৌড়ে ছাদে যাই। গিয়ে দেখি দুজনের ঝুলন্ত মরদেহ। আমি মরদেহ নিচে নামাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সবাই বলেন, পুলিশ আসুক।’

এক প্রশ্নের জবাবে রাজন বলেন, ‘তারা রাগ করে এমন কাজ করেছে। আমার যে বড় বোন রানী, তার খুব বেশি রাগ। তার মাথায় সমস্যা আছে। সে ভালো মানুষ এলেও ঝগড়া করে, আত্মীয়স্বজন এলে ঝগড়া করে। ডাক্তার বলেছে- তার মাথায় সমস্যা, তাকে নিয়ে কেউ কোথাও যেও না।’

‘সে (রানী) আমার আরেক বোনকে (ফাতেমা) নিয়ে মরার কথা বলেছিল। সে বলেছিল, মরবো যখন গা-ঘর জ্বালিয়ে মরবো। বিয়ের আলাপ আসায় তার হিংসে ঢুকেছে যে, আমি বিয়ে করবো কেন। তার মাথা গরম হয়ে যায়। সে নিজে নিজে ফাঁসি লাগিয়ে আমার বোনকে নিয়ে মরেছে।’

রানী-ফাতেমার ‘আত্মহত্যার’ বিষয়ে সিলেট সিটি করপোরেশনের ৪নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর রেজাউল হাসান কয়েস লোদী মঙ্গলবার বলেন, ‘তাদের চাচাতো ভাই আমাকে যেটা বললেন যে, কাল (সোমবার) রাতে নাকি দুই বোন দা নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে চাচার বাসায় যান। তখন তিনি জিজ্ঞেস করেন, তাদের সমস্যা কী হয়েছে? চলো, আমিও তোমাদের বাসায় যাবো। তখন ওই দুই বোন নাকি বলেছে, তুমি যেও না; গেলে তোমাকেও তারা মারবে। এই ‘তারা’ আসলে কারা? কে তাদেরকে মারতে চেয়েছিল?”

লোদী বলেন, ‘এই বাসায় কাল রাতে আসলে কী হয়েছিল, কেনইবা তারা আশ্রয়ের জন্য বেরিয়ে গিয়েছিল, তাদের হাতে দা কেন ছিল, এরপর আশপাশের লোকজন ভোরে তাদেরকে ঝুলন্ত অবস্থায় ছাদে দেখতে পায়। বিষয়টি নিয়ে আসলে আমি বলতে পারবো না, বলাটা সমীচীনও হবে না। ময়নাতদন্তের পরই জানা যাবে, আসলে কী হয়েছিল। তদন্তসাপেক্ষে আসলে বেরিয়ে আসবে, এই ঘটনার সাথে কারা জড়িত, কী কারণে ঘটনাটি ঘটেছে, কারাইবা তাদেরকে কাল রাতে বাসা থেকে বের হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি করেছিল, কেনইবা তাদের হাতে দা ছিল, তা পরিষ্কার হবে।’

কাউন্সিলর লোদী বলেন, ‘পরিবারের সদস্যদের বক্তব্য পরস্পরবিরোধী মনে হয়েছে। তারা তাদের বক্তব্যে একই জায়গায় থাকছেন না। তারা এই এলাকার আদি বাসিন্দা, কিন্তু এলাকায় তাদের সেরকম কোনো সামাজিক সম্পর্ক নেই। একধরনের আইসোলেটেড জীবনযাপন করে তারা। ঘটনাটি শুনে আমার কাছে সন্দেহজনক মনে হয়েছে।’

সর্বশেষ বুধবার (২২ সেপ্টেম্বর) বিকেলে এসএমপি’র এয়ারপোর্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খান মোহাম্মদ মাইনুল জাকির বলেন, গতকাল (মঙ্গলবার) রাতে তাদের দাফন সম্পন্ন হয়েছে। এ ঘটনায় এখনও কাউকে আটক করা হয়নি। তবে প্রয়োজনে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য যে কাউকে পুলিশ থানায় নিয়ে আসতে পারে।

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *